বাল্ট্রা দ্বীপ প্রকৃতির এক রহস্যময় বিচিত্র সৃষ্টি !
মানুষ রহস্যপ্রিয়। তাই ক্রমগত তারা অজানা সব রহস্যের পিছনে ছুটে চলে। কিন্ত প্রকৃতির সব বিচিত্র রহস্যের সমাধান এখনো মানুষের দ্বারা উন্মোচন করা সম্ভব হয় নি। প্রকৃতির বিচিত্র কিছু দ্বীপ অমীমাংসিত রহস্য হিসেবে আজও বিস্ময়ের সৃষ্টি করে রেখেছে। তেমনই এক রহস্যময় দ্বীপের নাম বাল্ট্রা দ্বীপ।
বাল্ট্রা দ্বীপের অবস্থান ও পরিচিতি
মানব বসতি শূন্য একটি দ্বীপ হল বাল্ট্রা। বাল্ট্রা দ্বীপ বা ইসলা বালত্রা গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত ছোট দ্বীপ। দ্বীপটি অনেকের কাছে দক্ষিণ সিমুর (লর্ড হিউ সিমুর-এর নামে) নামেও পরিচিত। বাল্ট্রা দ্বীপটি গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের কেন্দ্রে অবস্থিত একটি ছোট সমতল দ্বীপ।ইকুয়েডরের গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের একটি বিশেষ দ্বীপ এটি। গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ দক্ষিণ আমেরিকার ইকুয়েডরের নিকটবর্তী ১৩টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত । আর গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের এই ১৩টি দ্বীপের একটি হচ্ছে বাল্ট্রা। অবাক করা ব্যাপার হলে যে এখানকার অন্য ১২টি দ্বীপ থেকে বাল্ট্রা একেবারেই আলাদা, অদ্ভুত এবং রহস্যময়। এই ভূ খন্ডটি অভিশপ্ত দ্বীপ পরিচিত লাভ করেছিল।
দ্বীপটির আয়তন ২১ বর্গ কিলোমিটার আর দ্বীপের সর্বোচ্চ চুড়ার উচ্চতা হল ১০০ মিটার।
দ্বীপের জীব বৈচিত্র
এই দ্বীপ খুব শুষ্ক এবং ছোটখাটো শক্ত ঝোপঝাড়পূর্ণ । দ্বীপটিতে তেমন মানুষের বসবাস নেই। আর মানব বসতি নেই বলে অনেকে একে মৃত দ্বীপ বলেও ডাকা হত । তবে প্রচলিত আছে কয়েক শতাব্দি আগে এখানে মানুষের বসতি ছিল। কোন এক অজানা রোগে লোকজন মরতে থাকতে। এই মরার প্রকোপ কমতে না থাকায় এক সময় দ্বীপ বাসীরা এই দ্বীপ ছেড়ে পালিয়ে যায়। দ্বীপ ছেড়ে আসা লোকজন প্রচার করে দ্বীপটি অভিশপ্ত । কেউ একবার গেলে আর হয়ত প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পারবে না। এর পর থেকে দ্বীপটি বিশ্ববাসীর কাছে অভিশপ্ত দ্বীপ হিসেবে পরিচয় লাভ করে।
বাল্ট্রা বাদে গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের প্রতিটি দ্বীপেই আছে সিলমাছ, ইগুয়ানা, দানবীয় কচ্ছপ, গিরগিটিসহ বিরল প্রজাতির কিছু পাখি। কিন্তু বাল্ট্রার দ্বীপে কোনো উদ্ভিদ, প্রাণী বা কীটপতঙ্গ নেই। তেমন কোন বড় গাছপালা না থাকলেও বাল্ট্রা দ্বিপ একজাতের ফণীমনসা এবং পালো সান্টো গাছে পরিপূর্ণ।
বাল্ট্রা দ্বীপটি গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ জাতীয় উদ্যানের অন্তর্গত। গালাপাগোস ইগুয়ানা নামে এক প্রজাতির সরিসৃপ একসময় এই দ্বীপে বসবাস করত এবং পরবর্তীতে তা বিলুপ্ত হয় যায় বলে জানা যায় । তবে ইকুয়েডর সরকার বর্তমানে প্রজাতিটি দ্বীপে অবমুক্ত করেছে।
বাল্ট্রা দ্বীপ কেন রহস্যময় দ্বীপ হিসেবে পরিচিত ?
বাল্ট্রা দ্বীপের অদ্ভুত রহস্যের কথা বিশ্ববাসী জানতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কৌশলগত কারণে এ দ্বীপপুঞ্জের কয়েকটি দ্বীপে বিমানঘাঁটি স্থাপন করেছিল মার্কিন সরকার। তখনই এই দ্বীপের রহস্যময় ব্যাপারগুলো বিশ্ববাসীর দৃষ্টিগোচর হয়। পানামা খালকে সুরক্ষিত রাখা এবং পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে বাল্ট্রা দ্বীপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই মার্কিন সরকার এখানে বিমানঘাঁটি স্থাপন করেছিল।
যুদ্ধের পর মার্কিন কতৃপক্ষ ইকুয়েডর সরকারের কাছে দ্বীপটি হস্তান্তর করা করে । বাল্ট্রা দ্বীপটি বর্তমানে ইকুয়েডর সেনাবাহিনীর একটি সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ফ্রান্সিস ওয়াগনার নামে এয়ারবেসের একজন অফিসার এর মাধ্যমেই বিশ্ববাসী প্রথম জানতে পারে বাল্ট্রা দ্বীপের সব অদ্ভুত রহস্যময় চরিত্র । এরপর থেকে অনেকেই এই দ্বীপের রহস্যময় আচরণের কথা স্বীকার করেন।
এ দ্বীপপুঞ্জে থাকাকালীন সময়ে ফ্রান্সিস ওয়াগনার বিভিন্ন অদ্ভুত ঘটনা আর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন । পরবর্তিতে এই সব বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হলে রীতিমতো বিস্ময়ের ঝড় ওঠে। তিনি লিখেছেন,
জীবনের সবচেয়ে বড় বড় বিস্ময়কর ঘটনাগুলোর মুখোমুখি হয়েছি আমি বাল্ট্রা দ্বীপে গিয়ে। একটা নয় দুটো নয়, একের পর এক অসংখ্য অবিশ্বাস্য সব ব্যাপার ঘটেছে আমার চোখের সামনে। বিস্ময়ে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দ্বীপপুঞ্জ হওয়ায় এই এলাকাতে প্রচুর বৃষ্টি হয়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, এক ফোঁটা বৃষ্টিও বাল্ট্রাতে দ্বীপে পড়ে না । কোন এক রহস্যজনক কারণে বৃষ্টি বাল্ট্রার অনেক ওপর দিয়ে গিয়ে অন্যপাশে পড়ে। বৃষ্টি যত প্রবলই হোক কেন কোন এক যাদুর স্পর্শে যেন বৃষ্টি অন্য পাশে চলে যায় ! হতবাক আমি শুধু দৃষ্টি মেলে দেখেই গেছি এসব, কোনো যুক্তিযুক্ত উত্তর বা ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি।
উপযুক্ত কোনো উত্তর বা ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি। সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের একটি শক্তি কাজ করছে দ্বীপটির ভেতর। যার প্রভাবে ঘটেছে একের পর এক এসব রহস্যময় ও অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাল্ট্রাতে এলেই অস্বাভাবিক আচরণ করে নাবিক বা অভিযাত্রীর কম্পাস। সবসময় উত্তর দিক-নির্দেশকারী কম্পাস এখানে কোনো সময় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আবার দিক-নির্দেশক কাঁটা ইচ্ছেমতো ঘুরতে থাকে অথবা উল্টোপাল্টা দিক নির্দেশ করে। সবচেয়ে রহস্যজনক ব্যাপার হল বাল্ট্রা দ্বীপের ওপর বিমান থাকাকালীনও এমন অদ্ভুত আচরণ করে কম্পাস। আবার দ্বীপ পার হলেই সব ঠিক।
বাল্ট্রার আরেকটি অদ্ভুত দিক হল, এখানে পা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যে কারও মাথা অনেক হালকা হয়ে যায়। অজানা-অচেনা কোনো এক জায়গায় হারিয়ে যাওয়ার আশ্চর্য রকম অনুভূতি আচ্ছন্ন করে ফেলে মনকে। বেশিক্ষণ এ দ্বীপে থাকলে, চলে আসার পরও কিছুদিন সেই আশ্চর্য অনুভূতি থেকে যায়। অদ্ভুত দ্বীপ বাল্ট্রায় কোনো গাছ নেই। নেই কোনো পশুপাখি। কোনো পশুপাখি এ দ্বীপে আসতেও চায় না। দেখা গেছে, বাল্ট্রাকে এড়িয়ে পাশের দ্বীপ সান্তাক্রুজের ধার ঘেঁষে চলছে প্রাণীগুলো। শুধু তাই নয়, উড়ন্ত পাখিগুলোও উড়তে উড়তে বাল্ট্রার কাছে এসেই ফিরে যাচ্ছে। দেখে মনে হয় যেন কোনো দেয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে ওরা।
দ্বীপের বর্তমান অবস্থা
১৯৬০ সাল থেকে দ্বীপটি পর্যটকদের একটি গন্তব্য হিসেবে রুপান্তর হলেও দ্বীপ ১৯৯০ এর দিকে থেকে পর্যটকদের আকর্ষনে পরিণত হয়। দ্বিপে সিমুর নামে একটি বিমান বন্দর রয়েছ। সিমুর বিমানবন্দরে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা সেবা পাওয়া যায়।
বাল্ট্রা দ্বীপে দু’টি ফেরিঘাট রয়েছে। পর্যটক আকর্ষণ ও অন্যান্য উদ্দেশ্যে ইকুয়েডর সরকার দ্বীপটির সার্বিক উন্নয়নের জন্য কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ২০০০০০ পর্যটক বাল্ট্রা দ্বীপে বেড়াতে আসে।
পৃথিবীর রহস্যময় স্থানসমূহ যেমন মানুষের আকৃষ্ট করে তাদের রহস্যময়তার জন্যে তেমনি বাল্ট্রা মানুষকে আকর্ষণ করে। বাল্ট্রা দ্বীপের রহস্যেগুলোর কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীরা আজও এ রহস্যের কোনো কূল কিনারা করতে পারেননি। হয়ত অদূর ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীরা সে সব রহস্যের ব্যাখাগুলো প্রদান করে আমাদের আগ্রহ নিবৃত্ত করবেন।
তথ্য সূত্রঃ উইকি, অনলাইন পোর্টাল ।