ডাউন সিনড্রোম: চেনার উপায়, প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা

ডাউন সিনড্রোম একটি বংশানুগতিক বা জিনগত সমস্যা , যা মানব শরীরের অতিরিক্ত ক্রোমোসোমের কারণে সৃষ্টি হয়। সাধারণভাবে, একজন মানুষের শরীরে ২৩ জোড়া ক্রোমোসোম থাকে, যার মধ্যে ২১তম ক্রোমোসোমের অতিরিক্ত কপি থাকলে ডাউন সিনড্রোম দেখা দেয়। এই অবস্থা জন্ম থেকেই থাকে এবং শারীরিক ও মানসিক বিকাশে প্রভাব ফেলে। তবে ডাউন সিনড্রোমের বৈশিষ্ট্য এবং স্বাস্থ্য সমস্যা ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন হতে পারে। এই প্রবন্ধে আমরা ডাউন সিনড্রোম কি, এটি কিভাবে চেনা যায়, প্রতিরোধের উপায়, এবং চিকিৎসা সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা করব।

ডাউন সিনড্রোম কি?

ডাউন সিনড্রোম হলো একটি বংশানুগতিক সমস্যা যা ‘ট্রাইসোমি ২১’ নামেও পরিচিত। এতে ব্যক্তির ২১তম ক্রোমোসোমের একটি অতিরিক্ত কপি থাকে, অর্থাৎ যেখানে দুটি ক্রোমোসোম থাকার কথা, সেখানে তিনটি ক্রোমোসোম থাকে। এটি একটি সাধারণ জন্মগত সমস্যা, এবং বিশ্বজুড়ে প্রায় ৭০০ থেকে ১,০০০ শিশুর মধ্যে একজন এই অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে।

১৮৬৬ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক জন ল্যাঙ্গডন ডাউন এ বৈশিষ্ট্যের শিশুদের প্রথম চিহ্নিত করেন, তাই তার নামা অনুসারে নামকরণ করা হয় ডাউন সিনড্রোম। বিশ্বে প্রতি ৫০০ থেকে ৭০০ শিশুর মধ্যে একজন শিশু ডাউন সিনড্রোম শিশু হিসাবে জন্মগ্রহণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর ৫০০০ বা প্রতিদিন প্রায় ১৫ জন ডাউন সিনড্রোম শিশুর জন্ম হয়। ডাউন সিনড্রোম (Down syndrome) সংক্ষেপে DS বা DNS নামে পরিচিত।

আমাদের শরীরে ২৩ জোড়া ক্রোমোজম রয়েছে, অর্থাৎ ৪৬টি। এর মধ্যে ২৩টি আসে প্যাটার্নাল সাইড থেকে, ২৩টি ম্যাটার্নাল সাইড থেকে। ডাউন সিনড্রোমের ক্ষেত্রে ৪৭টি ক্রোমোজম থাকে। একটা বাড়তি ক্রোমোজম থাকে এবং সেটা ক্রোমোজম বিন্যাসের ২১তম পজিশনে থাকে। এ কারণে একে ট্রাইসোমি ২১ ও (Trisomy 21) বলা হয়ে থাকে অর্থাৎ ক্রোমোজমগুলো তো জোড়ায় জোড়ায় থাকে কিন্তু এক্ষেত্রে ২১তম জোড়ায় ৩টি ক্রোমোজম থাকে। ডাউন সিনড্রোম একটি জেনেটিক ডিজওর্ডার। যাদের এই সমস্যা আছে তাদের জন্মের আগে ও পরে বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। 

ডাউন সিনড্রোমের প্রকারভেদ:

ডাউন সিনড্রোম সাধারণত তিনটি প্রকারে বিভক্ত করা হয়:

১. ট্রাইসোমি ২১: এটি সবচেয়ে সাধারণ ধরন, যেখানে ২১তম ক্রোমোসোমের অতিরিক্ত কপি শরীরের প্রতিটি কোষে থাকে। প্রায় ৯৫% ক্ষেত্রে এই ধরনের ডাউন সিনড্রোম দেখা যায়।

২. মোজাইসিজম: এই অবস্থায় কিছু কোষে অতিরিক্ত ২১তম ক্রোমোসোম থাকে, কিন্তু সব কোষে নয়। এটি তুলনামূলকভাবে বিরল, এবং প্রায় ১-২% ক্ষেত্রে দেখা যায়।

৩. ট্রান্সলোকেশন: এটি তখন ঘটে যখন ২১তম ক্রোমোসোমের অংশবিশেষ অন্য কোনো ক্রোমোসোমের সঙ্গে যুক্ত হয়। প্রায় ৩-৪% ক্ষেত্রে এটি ঘটে।

কিভাবে ডাউন সিনড্রোম চেনা যায়?

ডাউন সিনড্রোম চেনার জন্য কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক এবং বৌদ্ধিক বৈশিষ্ট্য থাকে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো শিশুর জন্মের পর পরই লক্ষ করা যায়, তবে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেও এটি চিহ্নিত করা সম্ভব। এর মধ্যে কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো:

১. মুখমণ্ডলের বৈশিষ্ট্য: ডাউন সিনড্রোম আক্রান্ত ব্যক্তিদের মুখ সাধারণত কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়। যেমনঃ ছোট মাথা, ফ্ল্যাট নাক, চোখের কোণে বিশেষ ধরনের ভাঁজ, ছোট কান এবং অল্প চওড়া জিহ্বা। ডাউন সিনড্রোমের প্রধান কারণ হলো ক্রোমোসোম বিভাজনে ত্রুটি। চোখের আইরিসে (রঙিন অংশ) ছোট সাদা দাগ থাকতে পারে।

২. হাত ও পায়ের গঠন: হাত ও পায়ের আঙুল তুলনামূলকভাবে ছোট হতে পারে, এবং হাতে এক ধরনের একক রেখা থাকতে পারে।

৩. পেশী শক্তি হ্রাস: এরা কিছুটা স্থুল ও খর্বাকৃতির হয়। পেশীর শক্তি কম হওয়ার কারণে শিশুদের বসা, হাঁটা, বা দাঁড়াতে সময় বেশি লাগে। শরীরের মাংসপেশী খুব দুর্বল হয় তাই এ ধরণের শিশু নরম তুলতুলে হয়ে থাকে, যাকে ফ্লাপি বেবি বলে। 

৪. হৃদযন্ত্রের সমস্যা: প্রায় অর্ধেক ডাউন সিনড্রোম আক্রান্ত শিশু জন্মগত হৃদযন্ত্রের সমস্যায় ভুগে থাকে।

৫. বুদ্ধিমত্তার হ্রাস: ডাউন সিনড্রোম আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে মানসিক বিকাশ কিছুটা ধীরগতি থাকে এবং বুদ্ধিমত্তা কম হতে পারে।

মানসিক ও সামাজিক লক্ষণ:

১. শেখার ক্ষমতা: ডাউন সিনড্রোম আক্রান্ত ব্যক্তিদের শেখার ক্ষমতা কিছুটা সীমিত হয়, তবে তা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে।

২. বক্তব্য প্রদান: ভাষা ও বক্তব্যের বিকাশ তুলনামূলকভাবে দেরিতে হয়। অনেকেই ভাষায় বিশেষ ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়।

৩. সামাজিক যোগাযোগ: তারা সামাজিক পরিবেশে নিজেকে স্থাপন করতে পারে, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে সমস্যা হতে পারে।

ডাউন সিনড্রোম প্রতিরোধের উপায়

ডাউন সিনড্রোম প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এখনও কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, কারণ এটি বংশানুগতিক সমস্যা। তবে কিছু নির্দিষ্ট কারণ এবং পরিস্থিতির পর্যালোচনা করা যায়, যা ডাউন সিনড্রোমের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হতে পারে:

মাতৃবয়স:

মায়ের বয়সের সঙ্গে ডাউন সিনড্রোমের ঝুঁকি সরাসরি সম্পর্কিত। যেসব মহিলার বয়স ৩৫ বছরের বেশি, তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই চিকিৎসকরা সাধারণত বয়স্ক মহিলাদের মধ্যে গর্ভধারণের পূর্বে বংশানুগতিক পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন।

Maternal AgeIncidence of Down Syndrome
201 in 2,000
211 in 1,700
221 in 1,500
231 in 1,400
241 in 1,300
251 in 1,200
261 in 1,100
271 in 1,050
281 in 1,000
291 in 950
301 in 900
311 in 800
321 in 720
331 in 600
341 in 450
351 in 350
361 in 300
371 in 250
381 in 200
391 in 150
401 in 100
411 in 80
421 in 70
431 in 50
441 in 40
451 in 30
461 in 25
471 in 20
481 in 15
491 in 10

বংশানুগতিক পরামর্শ:

যেসব পরিবারের ইতিহাসে ডাউন সিনড্রোমের ঘটনা আছে, তাদের জন্য বংশানুগতিক পরামর্শ নেওয়া জরুরি। এতে করে তারা জানতে পারে যে তাদের ভবিষ্যৎ সন্তান এই সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কতটা।

গর্ভাবস্থায় স্ক্রিনিং পরীক্ষা:

গর্ভাবস্থার প্রথম বা দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে নির্দিষ্ট কিছু স্ক্রিনিং পরীক্ষা করে ডাউন সিনড্রোমের ঝুঁকি আগেই নির্ণয় করা সম্ভব। যেমন:

  • নিউক্যাল ট্রান্সলুসেন্সি স্ক্যান: এটি গর্ভাবস্থার ১১ থেকে ১৪ সপ্তাহে করা হয়, যেখানে শিশুর ঘাড়ের পেছনের তরল পরিমাণ মাপা হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে শিশুর বংশানুগতিক সমস্যার প্রাথমিক ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
  • ট্রিপল বা কোয়াড স্ক্রিনিং টেস্ট: এই রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ডাউন সিনড্রোমের ঝুঁকি নির্ধারণ করা যায়।
  • অ্যামিনোসেন্টেসিস: গর্ভের শিশুর আশেপাশের তরল থেকে কিছু নমুনা নিয়ে ক্রোমোসোম বিশ্লেষণ করা হয়, যা ডাউন সিনড্রোম নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।

বাংলাদেশে ডাউন সিনড্রোম

২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ ডাউন সিনড্রোম সোসাইটি’। সোসাইটির চেয়ারম্যান সরদার আব্দুর রাজ্জাক ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “বাংলাদেশ ডাউন সিনড্রোম সোসাইটির উদ্যোগে ২০১৪ সালের ২১ মার্চ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ‘বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস’ উদযাপন করা হয়। তখন এটি বিশ্বে ছিলো নবম বারের মতো। তারপর থেকে প্রতিবছর উদযাপন হয় । তবে এর সরকারি স্বীকৃতি পাওয়া যায় ২০১৬ সালে এসে। এখন সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে সারা দেশ জুড়েই দিবসটি পালন করা হয়। 

ডাউন সিনড্রোমের চিকিৎসা

ডাউন সিনড্রোমের জন্য কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, তবে আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক বিকাশ উন্নত করার জন্য কিছু চিকিৎসা ও থেরাপি করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে তাদের দৈনন্দিন জীবন সহজ করা সম্ভব হয়। চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে কিছু নির্দিষ্ট দিকের উপর ফোকাস করা হয়:

চিকিৎসা এবং থেরাপির ধরন:

১. শারীরিক থেরাপি: শারীরিক থেরাপির মাধ্যমে পেশীর শক্তি এবং গতিশীলতা বৃদ্ধি করা হয়। এটি বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে কার্যকরী, কারণ এতে করে তারা ঠিকভাবে হাঁটতে এবং বসতে শিখতে পারে।

২. বক্তব্য থেরাপি: ভাষা বিকাশে সমস্যা হলে বক্তব্য থেরাপি কার্যকরী হতে পারে। এর মাধ্যমে তারা কথা বলতে এবং যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়।

৩. শিক্ষাগত সহায়তা: ডাউন সিনড্রোম আক্রান্ত শিশুদের জন্য বিশেষ শিক্ষা প্রয়োজন হতে পারে। শিক্ষকরা তাদের জন্য এমন শিক্ষাক্রম তৈরি করেন যা তাদের বুদ্ধিমত্তার স্তর অনুযায়ী মানানসই হয়।

৪. অকুপেশনাল থেরাপি: এই থেরাপি ব্যক্তি কীভাবে দৈনন্দিন কাজগুলি আরও কার্যকরীভাবে করতে পারে তা শেখাতে সহায়ক হয়। এতে তারা স্বনির্ভর হতে শেখে।

৫. হৃদযন্ত্রের চিকিৎসা: যদি ডাউন সিনড্রোম আক্রান্ত শিশুর হৃদযন্ত্রের সমস্যা থাকে, তবে সেই সমস্যার জন্য চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে।

৬. মনোবিজ্ঞানী সহায়তা: মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা থাকলে একজন মনোবিজ্ঞানী তাদের সহায়তা করতে পারেন।

পারিবারিক সহায়তা:

ডাউন সিনড্রোম আক্রান্ত ব্যক্তিরা পরিবারের কাছ থেকে বিশেষ যত্ন ও সহায়তা প্রয়োজন। পরিবার যদি তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে, তবে তারা অনেকক্ষেত্রেই সামাজিক পরিবেশে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়। পরিবারের সদস্যরা তাদের সঙ্গে বেশি সময় কাটানো, তাদের শেখানোর এবং উৎসাহিত করার মাধ্যমে তাদের দৈনন্দিন জীবন সহজ করতে পারেন।

শেষ কথা

ডাউন সিনড্রোম একটি বংশানুগতিক অবস্থা যা ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক বিকাশে প্রভাব ফেলে। যদিও এই সমস্যাটি সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন স্ক্রিনিং ও পরীক্ষার মাধ্যমে এর ঝুঁকি নির্ধারণ করা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক চিকিৎসা ও থেরাপির মাধ্যমে ডাউন সিনড্রোম আক্রান্ত ব্যক্তিরা শারীরিক ও মানসিক বিকাশে অনেকটা অগ্রগতি অর্জন করতে পারেন। পারিবারিক সহায়তা এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তি তাদের আত্মনির্ভর হতে সহায়ক হয়, এবং শিক্ষামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা সমাজে সুস্থ জীবনযাপন করতে সক্ষম হয়।

ডাউন সিনড্রোম সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সমাজের সকল স্তরে তাদের মর্যাদা ও সহানুভূতি নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

নোটঃ আর্টিকেলটি চ্যাট জিপিটির সহায়তার লেখা হয়েছে।

মনজু
 

Click Here to Leave a Comment Below 0 comments

Leave a Reply: