বানারি চর ব্যাক-প্যাক ক্যাম্পিং রাইড (গোপন সিজন-৪)
ব্যাক-প্যাক ট্যুর মানেই দারুন মজার কিছু। প্রয়োজনীয় সব কিছু গুছিয়ে ব্যাগে নিয়ে কোন দিকে ছুটে চলা। গোপন ট্রাভেলার্স এর আগে শুধুমাত্র তাদের নিজেদের কোর মেম্বার নিয়ে তিনটি সিজন এডভেঞ্চার রাইড দিয়েছিল। তাদের ট্যুরের ছবি আর বর্ণনা শুনে হিংস হচ্ছিল। এবার ইভেন্ট ক্রিয়েট করার পর ১৫ জনের একটা প্রাথমিক লিস্ট চূড়ান্ত করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আমি যে দিন দেখি এর পরের দিন হাসান ভাইকে ফোন দিলে বলে তাদের কোটা ফিল আপ হয়ে গেছে । কোটার কারন ছিল তাবু স্বল্পতা। ইভেন্ট আয়োজক গোপনের মেম্বাররাই সব তাবু আর প্রয়োজনীয় সব কিছুর যোগান দিচ্ছিল। যাই হোক মন খারাপ হয়। দুই একদিন পর হাসান ভাই আবার নক দেন যে তাবু ম্যানেজে হয়েছে ইচ্ছে করলে যেতে পারি। আমি দেরি না করে কনফার্ম করি। এর মধে আমার এক ফ্রেন্ড এবং ছোট ভাই যাবা কথা ছিল । ওরা সংগত কারনে যেতে পারে নি।
যাই হোক ২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ খুব ভোরে উঠে সাইকেল নিয়ে মিটিং প্লেস সাইনবোর্ড যাবার জন্যে রেডি হই । আগের দিন রাতে প্রভাত ভাইকে বলে রাখি আমাকে নিয়ে যেতে। প্রভাত ভাই তন্ময় ভাইকে সাথে করে আমার জন্যে ওয়েট করে। এক সাথে সাইনবোর্ড পৌছাই। ক্যাপসুল মাসুম, অয়ন, জামিল , হাসান ভাই্সহ সবাই মিলে ইচ্চামত আড্ডাবাজি শুরু হয়।
সকল মেম্বাররা পৌছালে আমরা সাইনবোর্ড হয়ে চাষাড়া দিয়ে বানারি চরের পথে রওনা দেই। চাষাড়া গিয়ে মোড়ে হয়ে আমরা সোজা চলে যাই মুক্তারপুর ব্রিজের দিকে। ঐ দিকে আমার আগে আর যাওয়া হয় নি। মুক্তার পুর ব্রিয় দেখি ইয়া উচু আর ঢালু। মাঝখানে কোন সমতল জায়গা নেই। কর্নফুলি ব্রিজের মত। কিন্ত কর্নফুলী ব্রিজ থেকে আরো অনেক বড়। যাই হোক কষ্টে সৃষ্টে সাইকেল নিয়ে সবাই উঠে যাই ব্রিজের মাঝে। ।
ব্রিজ থেকে নেমে মুন্সিগঞ্জ লঞ্চঘাট গিয়ে সকালের নাস্তা সারি । মুন্সিগঞ্জ সদর হতে সাদমান, রাহাদ , অথৈ ও তাদের আর একটা ফ্রেন্ড আমাদের সাথে যোগ দেয়। দুই জন অটো নিয়ে হাড়ি পাতিল সহ রওনা দেয়। নাস্তা সেরে আমরা টঙ্গিবাড়ির পথে রওনা দেই। অনেকটা পথ রাস্তার দু পাশে পানি । চারদিকে শুনশান নিরবতা ।
গ্রামের উৎসুক মানুষ আমাদের আগ্রহ ভরে দেখছিল। বারটার কাছাকাছি সময়ে আমরা সাইকেল নিয়ে পৌঁছাই হাসাইল বাজারে। বাজারের পাশেই পদ্মা নদীর। নদীর ওপারে বানারী চর। চর ৪-৫ হাত পানির নিচে তলিয়ে যায়। ইতিমধ্যে আমরা আমাদের জন্যে প্রয়োজনীয় বাজার সদাই সেরে নেই। মাসুম ভাই সাদমান আর হাসান ভাইকে নিয়ে বাজার করে। আর আমরা ট্রলারে বসে ঝিমাই।
দুপুর দুইটার কাছাকাছি সময়ে অনেক আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেই যেই বানারী চর পার হয়ে গুচ্ছগ্রামে তাবু ফেলব। নদীতে প্রচন্ড স্রোত। ট্রলারে করে ওপারে যাই রাস্তার উপর দিয়ে ট্রলার চলতে থাকে। চার পাশের সব ভেসে যায়। মাঝে মাঝে অবশ্য ট্রলার আটকে যায় অনেক কষ্টে আমরা গুচ্ছ গ্রামের ব্রিজের কাছে পৌছাই। গিয়ে দেখি ব্রিজ ছাড়া দুই পাশের রাস্তা পানির নিচে। রাস্তা ধরে আমরা এগিয়ে যেতে চাই ; একটু যেতেই ট্রলার আটকে যায় রাস্তাতে।
এর পরে অনেক আলোচনা করে আমরা আবার ফিরে আসি বানারী চরে । বানারী চরে একমাত্র রাস্তাটা জেগে আছে । রাস্তার উপরই নেমে নেমেই তাবু টানানো শুরু করি । ইতিমধ্যে ৫টা বেজে যায়। দুপুরের খাবার আর খাওয়া হয় নি। বেশ কয়েকজন সাইকেলে করে রেকি করতে বের হয় । ওনারা এক কিলোর মত গিয়ে ফিরে আসেন । কারন রাস্তা বানের পানি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে যেখানে ঠাই পাওয়া যাচ্ছিল না । যদিও আরো কয়েক যায়গায় রাস্তা ভেসে গেছে তবে ঐ সব জায়গা পার হতে হাটু পানির মত উচ্চতা ছিল ।
রাস্তার মাথায়ই আমরা তাবু পিচ করি। নায়িম ভাই তার সৈন্য সামন্ত নিয়ে রান্নার কাজে নেমে পড়ে। তাবু টানিয়ে সবাই গোসলে নামে। কাচারির মত একটা মাথায় যার ভিটে বলতে কিছুই নাই। মাঝে বিশাল এক গর্ত। আমি বালি দিয়ে সেই গর্তে ২০ মিনিটে ভরাট করি রাতে যদি ঝড় ঝাপটা আসে আশ্রয় নিবার জন্যে।
ইতিমধ্যে সন্ধ্যা নেমে আসে। গোসলে নেমে শামুক দিয়ে পা এর তালুতে দেড় ইঞ্চির মত কেটে যায়। প্রচুর রক্তপাত হয়। ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। উঠে দেখি দুইটা তাবু বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যায়। :O
দুপুরের খাবার সিঙ্গারা, পুরি আর একটা করে বাটার বন দিয়া সারা হয়। পুরুদমে রান্নার কাজ চলে হঠাত করেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যায় তাবু গুলো গুটিয়ে কাচারি ঘরে নিয়ে আসা হয়। এই সেডটার উপরের দিয়ে ছিদ্র। মাসুম ভাই বৃষ্টিতে ভিজে উপরে পলিথিনের ছাউনি দেয় । আপাদত রক্ষা। ইতিমধ্যে প্রচুর পরিমানে বাতাসের সাথে বৃষ্টি হামলা চালায়। সবাই জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকি। বৃষ্টির প্রকোপ কমে আসলে নায়িম ভাই আবার রান্নার কাজে হামলে পড়ে। রাতের খাবার হয় খিচুড়ি আর মুরগির মাংস। এর পরে সবাই আড্ডাবাজিতে মেতে উঠি। কেউ আমরা কার্ড খেলতে থাকি কেউ বাইরে আড্ডাবাজি করে।
চার দিকে শুধু পদ্মার ঢেউ এর আওয়াজ। মনে হচ্ছিল এই বুঝি ভেঙ্গে পড়ে রাস্তা। কারন রাস্তাটি মাত্র মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। একদম নতুন মাটি। যেহেতু একটু পর পর ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল তাই ঠিক হয় তাবু আর টাঙ্গানো হবে না। রাতে পালা করে ঘুমানো হবে। কিন্ত কিসের ঘুম। আমি সারা রাতে মাত্র ৩০ এর মত ঘুমাই। সবাই চিল্লাপালা করে। আড়াইটার দিকে হঠাৎ করে ইঞ্জিনের আওয়াজ পাওয়া যায়। আমরা একটু সতর্ক হই। আবার না ডাকাত পড়ে। আবার কে যেন ওপারে ট্রলারে লাইট জালাচ্ছিল। 😛
সাড়ে তিনটার দিকে শুরু হয় চরম ঝড়-বৃষ্টি। সবাই এসে ছোট এই বেড়া ছাড়া ঘরে ঢুকে গুটি সুটি হয়ে বসে পড়ি। বেশিরভাগই ভিজে যাচ্ছিল । হঠাত করে দেখা যায় আমাদের নিচে বিছানো পলিথিন দিয়ে পানি উঠছে। আমাদের ব্যাগ গুলো ভিজিয়ে দেয়। :/
প্রায় পাঁচটা পর্যন্ত চলে এই আলামত। আস্তে আস্তে কমে কমে । ছয়টার কাছাকাছি সময়ে পুরু পুরি থেমে যায়। সকালে বেলা টয়লেট নিয়ে হয় মহা মজার ঘটনা। আশেপাশে সারা কোন ব্যবস্থা নাই । একেক জন একেক আইডিয়া দেয়। 😛 আমি সাইকেল নিয় হাফ কিলোমিটার ভিতরে চলে যাই। আমার দেখা দেখি মাসুম ভাইও হাজির। 😛
সকাল বেলা আমাদের মাস্টার শেপ নায়িম ভাই আমাদের স্যুপ খাওয়ান। ওহ খাবার পানির সংকট দেখা দেয়। পানি রেশনিং করে খেতে হয় । রান্না বান্নার কাছ নদীর পানি দিয়েই সারা হয়। ইতিমধ্যে হাসান ভাই চলে যায় আস্ত একটা খাসি কিনে আনতে। দুপুরের পর নাগাদ হাসান ভাই ফিরে আসে বাজারে সেরা খাসি নিয়ে। 😀
দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ৪ সেপ্টেম্বর জামিল ভাই আর মাসুম ভাই দুপুরের রান্না করে। ডিম আর ডাল দিয়ে চলে খানা পিনা। এর আগে সবাই ফুটবল নিয়ে নদিতে ঝাপিয়ে পড়ি। 😀
বিকাল নাগাদ সব কিছু গুছিয়ে ফেলা হয়। আমি ক্যাম্প সাইট পরিষ্কার করার কাজে লেগে পড়ি। অয়ন ভাইও এসে যোগ দেয় আমার সাথে। পাশে পাশে অনেক পলিথিন ছিল ওইগুলো জড়ো করে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলি । খাবারে উচ্ছিষ্ট অংশ মাছের জন্যে নদীতে ফেলে দেই।
ট্রলারে করে এপারে এসে হাসাইল বাজারের কাছকাছি বালুর মাঠে ক্যাম্প করার সিন্ধান্ত নেওয়া হয় । ইতিমধ্যে তিনটি তাবু পিচ করা হয় । আকাশে প্রচুর মেঘ দেখা যায়। নিশ্চিত যে তাবু সহ আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে। গুড়ু গুড়ু ডাক শুরু হয়। পাশেই একটা গোদাম ঘরে থাকার ব্যবস্তা করা হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে স্থানীয় একটি স্কুলে আমরা আশ্রয় নেই।
রান্না-বান্নার আয়োজন করতে করতে সাড়ে আটটা বেজে যায়। খাসি মাংস বোনা করা হয়। সাথে অসাধারন পায়েস/ ফিরনি। যথা রীতি নায়িম ভাই এর রান্না। বার বি কিউ এর জন্যে আনা কয়লা জ্বালানো যাচ্ছিল না । প্রায় ৩০-৪০ মিনিট কশরত করা পরে জ্বালানো যায়। আহারে রাফি বেচারা সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিল বাতাস করা নিয়ে। যাই হোক প্ল্যান ছিল রাতে বাজার থেকে পরোটা বা নান এনে খাবার কাজ সারা হবে । কিন্ত দেখা যায় বাজারে কিছুই নাই। কি আর করা অগত্যা মাসুম বাই বাটার বন নিয়ে ফেরত আছে। এটা দিয়েই ছলে ভুরিভোজ। আরো একবার সবাই স্বীকার করে নায়িম ভাই অসাধারন রান্না করেন।
রাতে কেউ কেউ তাবুতে ঘুমায়। আমি ভু,রদা এন্ড নায়িম ভাই স্কুলের ভিতরে বেঞ্চে শরীরের অর্ধেক কোন লাগিয়ে শুয়ে পড়ি। ভোরে উঠে আবার প্যাক করার কাজ শুরু করি আমরা।ক্যাম্প সাইট পরিষ্কারে এবার নামি আমি আর বাদল ভাই। সব কিছু গুছিয়ে সাইকেলে এসে দেখি রাস্ট। কি আর করা কেরোসিন দিয়ে আপাদত ক্লিন করে বাজারে গিয়ে নাস্তার সেরে রওনা দেই। প্রচন্ড গরম পড়ে । ৩৭-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস প্রায়।
গরম ছিল আবার পুরুপুরি রোদও ছিল না আবার বাতাসও নাই । বিরক্তিকর গরম । মুন্সিগঞ্জের ছেলেগুলো মুক্তারপুর ব্রিজ পর্যন্ত এগিয়ে দেয় আমাদের। এর পরে নারায়নগঞ্জ এসে দেখি আর চলছে না শরীর সবাই আখের রস খেয়ে রওনা দেই । এবার ডেমরা ঘুরে আসি । মাদার টেক এর আগে দেখি রাস্তায় কাজ চলছে। পুরা রাস্তা ভাঙ্গা । মেজাজ খিচকে যায় এমনিতেই প্রায় ৭ মাস পরে লং রাইডে বের হই । হাত পায়ে ব্যাথা হয়ে যায় । অবশেষে বাসার কাছে আসার পর নামে স্বস্তির বৃষ্টি।
৩- ৫ তারিখে ট্যুর ছিল আমার প্রথম যাওয়া ব্যাক-প্যাক ট্যুর । তবে অসাধারন লেগেছে। কেউ যেতে চাইলে নিচের ম্যাপ ফলো করতে পারেন। https://goo.gl/ViH1cR
আর পুরা ট্যুরের ছবি দেখতে চাইলে ক্লিক করতে পারে এখানে। 😀
গোপন সিজন-৫ নিঝুম দ্বীপ এর অরণ্যে ব্যাকপ্যাক ট্যুর