বঙ্গোপসাগরে রহস্যে ঘেরা নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপ
পৃথিবীতে এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে আপনি চাইলেও যেতে পারবেন না। সভ্য জগতের মানুষের পদচিহ্ন তেমন একটা পড়ে না। আর পড়লেও দেখা যায় অনেকে ক্ষেত্রে ফিরে আসা সম্ভব হয় না। তেমনি একটি স্থান হল নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপ।
বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত আন্দামান দীপপুঞ্জের অন্তর্গত একটি দ্বীপ হলো নর্থ সেন্টিনেল আইল্যান্ড। নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপে মানুষ থাকে ঠিকই! এখানে ‘সেন্টিনেলী’ নামক এক প্রাচীন উপজাতিদের বসবাস। তবে, সেই উপজাতি অন্য কোনও মানুষের সংসর্গ একেবারেই পছন্দ করে না। বহিরাগতদের ওপর আক্রমণাত্মক মনোভাবের জন্য সেন্টিনেলবাসী বিশেষভাবে পরিচিত। সেন্টিনেলী জাতি প্রধানত একটি শিকারী-নির্ভর জাতি। তারা তাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ শিকার, মাছ ধরা, এবং বন্য লতাপাতার মাধ্যমে পূরন করে থাকে। এখন পর্যন্ত তাদের মাঝে কৃষিকাজ করা বা আগুন ব্যবহারে প্রমাণ পাওয়া যায় না। সেন্টিনালিসদের কাছে তাদের ৭২ বর্গকিলোমিটার (১৮,০০০ একর) আয়তনের দ্বীপটিই যেন পৃথিবী।
১৯৭৫ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির একজন পরিচালক একটা তথ্যচিত্র বানাবার উদ্দেশ্যে গিয়ে পৌঁছিয়েছিলেন সেই দ্বীপে। কিন্তু হিংস্র উপজাতিরা তার পায়ে বিষাক্ত তীর মারে ফলে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। তখন থেকেই সেখানে কারও প্রবেশাধিকার নেই। তারপর আর কেউই সেখানে যেতে খুব একটা ঝুঁকি নেয় না।
কাগজে কলমে সেন্টিনেল ভারতের অধিকারে থাকলেও বাস্তবে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন। এখন পর্যন্ত ভারত সরকারও সেন্টিনেল দ্বীপ সম্পর্কে তেমন তথ্য সংগ্রহ করতে পারে নি। উল্লেখ্য কুট জাতি হিসেবে পরিচিত ব্রিটিশদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮৮০ সালে দ্বীপটি দখলের পায়তারা করে । এ উদ্দেশ্য তারা দ্বীপ থেকে কয়েকজন অধিবাসী ধরে নিয়ে আসে। অপহরনের উদ্দেশ্য ছিল তাদের ভাল খাবার দাবার পরিবেশ দিয়ে তাদের মন জয় করে দ্বীপের দখল নেওয়া। কিন্ত ব্রিটিশদের এই চেষ্টা গোড়াতেই শেষ হয়ে যায় । কারন দ্বীপবাসীদের ধরে আসার পর পরই দ্বীপবাসীরা মারা । এর কারন হিসেবে ধারনা করা হয় তাদের দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। সভ্য জগত থেকে অনেক কাল দূরে থাকায় ধারনা করা হয় সর্দি-কাশির মত সাধারন রোগে এরা মারা যেতে পারে !
১৯৬৭ সাল থেকে পোর্ট ব্লেয়ারে অবস্থিত ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সেন্টিনেলদের সাথে যোগাযোগ করার জন্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়ে আসছে। এসব অভিযানে তাঁদেরকে উপহার হিসেবে সমুদ্র সৈকতে খাবার ছড়িয়ে (যেমন: নারকেল) বন্ধুত্ব স্থাপনের চেষ্টা করা হয়। এসব প্রচেষ্টার মাধ্যমে সেন্টিনেলদের মধ্যে তৈরি বহিরাগতদের সম্পর্কে সৃষ্ট হিংস্র মনোভাব দূর করার চেষ্টা করা হয়। কিন্ত বাস্তবে এসব কোন কাজে আসে নি।
এর পরে ১৯৯১ সালে ভারত সরকার পুনরায় তাদের সাথে সন্ধি করার চেষ্টা করে। কিন্তু ১৯৯৬ সালে তারা জানিয়ে দেয় যে, তারা বাইরের পৃথিবীর কারও সাথে যোগাযোগ রাখতে চায় না। তারপর থেকে সেন্টিনালিসরা তাদের নির্বিঘ্ন জীবনে ফিরে যায়। পরে ২০০৪ সালের সুনামীতে দ্বীপের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়। ভারত সরকার পুনরায় দ্বীপ বাসীরা বেঁচে আছে কিনা জানা জন্যে হেলিকপ্টার পাঠায় দ্বীপ বাসীরা হেলিকপ্টারের দিকে তীর ছোড়ে স্বাগত জানিয়ে জানান দেয় যে তারা বেঁচে আছে।
২০০৬ সালে আন্দামান দ্বীপের দুইজন জেলে এ দ্বীপের কাছাকাছি মাছ ধরতে যায়। রাতের বেলা অত্যধিক মদ পানে ঘুমিয়ে পড়লে সমুদ্র স্রোতে ভেসে তারা দ্বীপে চলে যায়। দ্বীপ বাসীরা জেলেদের নিসংসভাবে হত্যা করে। ভারতীয় কোস্ট গার্ড জেলেদের লাশ উদ্ধার করতে হেলিকপ্টার পাঠায় দ্বীপ বাসীরা তাদের হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে তীর ছুড়তে থাকে। যদিও উদ্ধার অভিযানে আসা হেলিকপ্টার থেকে তাঁদের মরদেহ দেখা গিয়েছিলো। উদ্ধারকারী হেলিকপ্টারের পাখার ঘূর্ণনে সৃষ্ট প্রবল বাতাদের তোড়ে সেন্টিনেলদের অল্পগভীর কবরের মাটি সরে গিয়ে ঐ দুজন জেলের মৃতদেহ দেখা যায়। কোস্ট গার্ড তীরের মুখে লাশ উদ্ধার না করেই ফিরে আসে।
এর পর ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নেয় সেন্টিনল বাসীদের জীবন যাত্রা বাইরের প্রভাবমুক্ত রাখার। ভারত সরকার তাদের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা রক্ষার্থে দ্বীপের তিন কিলোমিটারের মধ্যে যাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে সেন্টিনেলীদের জনসংখ্যার কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে, ধারণা অনুযায়ী এদের জনসংখ্যা সর্বনিম্ন ৩৯ থেকে ২৫০-এর মধ্যে, এবং সর্বোচ্চ ৫০০ পর্যন্ত হতে পারে বলে ধারনা করা হয়। । ২০০১ সালে ভারত সরকার কর্তৃক পরিচালিত জনপরিসংখ্যানে ৩৯ জন পৃথক ব্যক্তির উপস্থিতি রেকর্ড করা হয় যাদের মাঝে ২১ জন পুরুষ ও ১৮ জন নারী। তবে নিরাপত্তাজনিত কারনে জরিপটি অনেক করায় এর সঠিক জনসংখ্যা পাওয়া যায় না।
চমৎকার একটি দ্বীপ নর্থ সেন্টিনেল আইল্যান্ড। দ্বীপটি খুব সহজেই আকর্ষণ করবে যে কাউকে। তবে চাইলেই আপনি এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন না !