স্বপ্নের ঢাকা-কক্সবাজার সাইকেল রাইড
ভ্রমনটি ২০১৩ সালের হলেও এখনো রোমাঞ্চ অনুভব করি।
শুরুর গল্পটা বিডিসি’কে দেখেই, কিভাবে এড হয়েছিলাম খেয়াল নেই। মেরিডা, লক্স সহ বেশ কিছু বাইকের রাইডের ছবি দেখি আর ভাবি আমাকেও একটা সাইকেলের মালিক হতেই হবে। ২০১২ সালের শেষ দিকে টিউশনির টাকা জমিয়ে কিনে ফেলি লক্সের একটা রোড বাইক। ঢাকা শহরে টু টু করে ঘুরে বেড়াই ।
২০১৩ সালের দিকে চারদিকে লং রাইডের জয় জয়কার, কেউ মুন্ডু মারে ছবি দেখি আর ভাবি আমি কবে লং রাইড দিব। স্মার্ট ফোন না থাকলেও ঢাকার আশে পাশের জেলাগুলোতে কয়েকবার আসা যাওয়া দিয়ে শুরু। লং রাইড বলতে তখন ১০০-১৫০ কিলোই অনেক মনে করতাম।
এর মধ্যে বিডিসিতে কেউ একজন ঢাকা-কক্সবাজারে রাইড আপডেট করতে থাকে । মাথায় পোকা ডুকে যায়।
মাথা থেকে বের হল ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সেসবাজার ভ্রমন ঈদ পরবর্তী ভ্রমন ….
আমাকে যেতেই হবে। রোড বাইক বিক্রি করে এমটিভি কিনি। Mesba Uddin ভাইকে বলাতে উনি রাজি হয় Jakir Hossainকে কিঞ্চিত ফোর্স করেই রাজি করিয়ে ফেলি।
কিন্তু ঈদের পরে হরতাল আর আবহাওয়ার কারনে পিছিয়ে গেল ষ্টার্টিং ডেট। বাসায় জানালে যেতে দিবে না । তাই না জানিয়েই ২০১৩ সালের আগস্টের ৩০ তারিখ ভোর ছয়টায় কাধে বিশাল ব্যাগ নিয়ে প্যাডেলে চেপে বসি।
প্যানিয়ার বা ক্যারিয়ারের চিন্তা তখন মাথায় ছিল না। সাতটার দিকে কাচপুর ক্রস করে মদনপুরে নাস্তার জন্যে থামতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে দেড় ঘন্টা বসে আছি।
বৃষ্টি থামার পর লক্ষন নেই, এ দিকে আমাদের প্রথম দিনের গন্তব্য কুমিল্লার শেষ দিকে কোথাও ধরেছিলাম। কারন আমার আর ফাহাদ ভাইয়ের আগে ১০০-১৫০ কিলো রাইডের অভিজ্ঞতা থাকলেও জাকিরের অভিজ্ঞতা খুব কম।
ভাবতেছিলাম এভাবে যদি বৃষ্টি হতে থাকে তাহলে আমাদের আর কুমিল্লা যাওয়া হবে না আজকে। দুই ঘন্টা পরে যখন বৃষ্টি কিছুটা কমে আসে তখন পলিথিনে ব্যাগ ঢুকিয়ে বৃষ্টিতেই রওনা দেই । যে করেই হোক আজকে কুমিল্লা যেতে হবে।
১৫-২০ কিলো মিটার পরে পরে চা/পানি’র ৭-৮ মিনিটের বিরতি দিয়ে আড়াইটা’র দিকে কুমিল্লা পৌছাই।
আগেই বন্ধুবর Billah Mamun কে বলে রাখি কুমিল্লা আসতেছি। একটা হোটলের লাঞ্চ করতে করতে বিল্লাহ দেখি হাজির । এসেই আমাদের জন্যে রস মালায় আনায়। যোহরের নামায পড়তে পড়তে সাড়ে তিনটা বাজে। বিল্লাহ শহর থেকে রাস্তা বলে দেয় কিভাবে যাব। ওর যাবার ইচ্ছে ছিল কিন্ত ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে তারেক ভাইরা কুমিল্লা এসে হাজির তাদের শহর ঘুরিয়ে দেখাতে হবে।
মাগরিব পড়ে দেখি রাস্তা গুরুতর অন্ধকার । তিনজনের কাছে দুইটা লাইট। ভাবতেছিলাম কই থাকব। কারন আমরা কোথায় থাকব এটি আগে থেকে ঠিক করে আসি নি, ভাবেছিলাম পথে কোথাও হোটেল থাকব। অগত্যা কোথাও জায়গা না পেলে মসজিদে রাত কাটাব। খুজ নিয়ে দেখি আশে পাশে কোথাও থাকার মত হোটেল নেই আছে ২০ কিলো মিটার সামনে চৌদ্দগ্রামের কোথাও।
যে দুই জনের লাইট আছে তার একজন সামনে আর একজন পিছনে থেকে যাত্রা আরম্ভ করি। বৃষ্টি ভেজা কাদাময় রাস্তায় ৫-৬ কিলোমিটার যাবার পরে দেখি আমার লাইট সমস্যা করছে । লাইটের আলো আপ ডাউন করছে। ঝাকি খেলে মাঝে মাঝে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে । সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় এইভাবে চৌদ্দগ্রাম বাজারে পৌছাই।
বাজারে পৌছে শুনি হোটেল বন্ধ। চিন্তায় পড়ে গেলাম কি করা যায়। চা খাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম। চার পাশে ইতিমধ্যে উৎসুক মানুষের ভীড়। একজনকে আমাদের ঘটনা বলার পরে উনি বললেন ৬-৭ কিলোমিটার সামনে ডলি রিসোর্ট নামে একটা রিসোর্ট চালু হয়েছে। ঐখানে থাকা যাবে।
ট্রাক আর বাসের হেডলাইটের আলোতে আবার এগিয়ে চলা। আমার লাইটের ব্যাটারি ইতিমধ্যে ডাউন। কোন রকমে ডলি রিসোর্টে পৌঁছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।
রিসেপশনে খুজ নিয়ে শুনি রিসোর্ট উদ্ভোধনের জন্যে চালু হয়েছিল এখন আবার বন্ধ। পুরু রিসোর্টে কাজ চলছে। ভাবছি কি করা যায়। মাথায় চিন্তা শেষ পর্যন্ত কি তাহলে মসজিদ খুজেই রাত কাটাতে হবে ?
হটাত করে মনে পড়ে অনেক দিন আগে আমার এক বন্ধু বলেছিল তার বাড়ি চৌদ্দগ্রাম।
তাকে কল দিলাম করে কই তুই
-হাই ওয়েতে আড্ডা দিচ্ছি।
– আমি চৌদ্দগ্রাম থেকে ৬-৭ কিলো দূরে ডলি রিসোর্টের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। তাকে সব খুলে বলি ।
– বলে বলিস কি আমি মাত্র সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে বাড়ি এসেছি। ওয়েট কর ১৫ মিনিট আসতেছি।
আল্লাহর কাছে শোকরিয়া জানালাম যে যাক অবশেষে থাকার ব্যবস্থা হল।
পরের দিন ভোরে রওনা দেই। ফেনিতে আর এক ফ্রেন্ড নাস্তা করায়। এর মধ্যে মহিপাল থেকে ১৩-১৫ কিলোমিটার দূরে এক লোডেড ট্রাকের হেল্পার আমার হেলমেট ধরে টান দেয় । এমনিতে প্রচন্ড বাতাসের জ্বালায় মাথা গরম হয়ে ছিল। শুরু করি ওর পিছনে ড্রাফটিং। পিছনে দুই জনের কথা ভুলে যাই। মহিপাল গিয়ে ট্রাককে ধরতে সক্ষম হই। একটু জ্যামে আটকা ট্রাকের সামনে সাইকেল থামিয়ে চিল্লা-পাল্লা শুরু করি। লোকজন এগিয়ে আসে।ট্রাকের ড্রাইভার সবার সামনে হেল্পারকে বকাবাজি করে ক্ষমা চায়।
দুই থেকে আড়াইটা নাগাদ সীতাকুন্ডের কাছাকাছি। ফাহাদ ভাইয়ের অবস্থা করুন। উনি আর পারছেন না উনার গায়ে কিছুটা জ্বর চলে আসে। কোন রকমে সীতাকুন্ড বাজারে পৌঁছে মসজিদে ঢুকে চিতপটাং। ফাহাদ ভাইয়ের চোখ লাল হয়ে যায়। রেস্ট নিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে মেইন রোডে আসলে ফাহাদ ভাই ট্রাকে চড়ে যাব বলে জানায়। উনার দিকে সত্যিই তাকানো যাচ্ছিল না।
আমি নাছোড় বান্দা ফাহাদ ভাই আপনাকে ট্রাকে তুলে দেই আপনি চলে যান চট্টগ্রাম আমরা আসতেছি। আবার কবে না কবে আসি , আপনারা না গেলে আমি একাই চালিয়ে যাব।
ফাহাদ ভাইয়ের ইগোতে আমার মেন্টাল টর্চার প্রচন্ড লাগে। উনিও রওনা দেয়। ভাটিয়ারির সলিমপুর গ্রামে যখন পৌছায় তখন সারে সাতটা বাজে।
আসিফ ভাইয়ের বাড়িতে রাজকীয় অথিয়তা পাই। পরের দুই দিন ভাটিয়ারি আর চট্টগ্রাম শহরে ঘুরে বেড়াই।
চট্রগ্রাম থেকে ৩ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। দুপুর নাগাদ ম্যাপের কল্যানে ৩০ কিলো ভুল পথে পরিচালিত হই। দুপুর ২-৩ টার দিকে ডুলা হাজড়া বাসস্টপে লাঞ্চ করে আবার রওনা দেই।
মাগরিব পড়ি কক্সবাজার থেকে ২০-২৫ কিলোমিটার দূরে কোথাও। নামাযে পড়ার পরে শুরু হয় তুফান।
প্রচন্ড বৃষ্টি আর ঝড়ে মসজিদও ভিজে যায়। এক ঘন্টা পরে বৃষ্টি নামার যখন লক্ষন নেই তখন ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আবার রওনা দেই। আমার লাইট প্রায় অন্ধ তখন। ফাহাদ ভাইয়ের লাইটে ভরসা করেই রওনা দেই। আটটা নাগাদ সোহাগ কটেজে পৌঁছে সাইকেল থেকে নেমে উল্লাসে লাফাতে ইচ্ছে করে।
যিনি ধৈর্য্যসহকারে এই ম্যারাথন ব্লগ পড়ে শেষ পর্যন্ত চলে এসেছেন এক কাপ চা দাওয়াত রইল দেখা হলে নিজ দায়িত্বে আদায় করে নিবেন। ?
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ মুন্ডু লিংক চেয়ে লজ্জা দিবেন না। গরিবের স্মার্ট ফোণ ছিল না তখন। :'(