ইনকা হারিয়ে যাওয়া এক রহস্যময় সভ্যতা ও মাচু পিচু
ইনকা সভ্যতার সাথে হয়ত আপনার পরিচয় নেই। তাই কি? উহ আমি বলব হয়ত সরাসরি ইনকা সভ্যতা বা সাম্রাজ্য নিয়ে ধারনা না থাকলে পরোক্ষভাবে হলেও আপনি তাদের সম্পর্কে শুনেছেন।
মাচু পিচু বা মাচ্চু-পিচ্চু (Machu Picchu ) হল আধুনিক সপ্তার্শ্চয্যের মধ্যে একটি। এর কথা কম বেশি সবাই শুনে থাকবেন। মাচু পিচু হল ইনকা সভ্যতার নিদর্শন। মাচ্চু পিচ্চুর কারনেই ইনকা সভ্যতার নাম সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে ।
আরো একটি কারনে হয়ত ইনকাদের সাথে অনেকের পরিচিত হয়েছে। ‘ল্য দোঞ্চেলা” নামক মমি। ‘ল্য দোঞ্চেলা’ নামের এই বালিকার মমিটিকে ১৯৯৯ সালে বিস্ময়কর মাচুপিচু নগরীর লুলাইকো আগ্নেয়গিরির ৬,৭৩৯ মিটার (২২,১১০ ফুট) উঁচুতে আবিষ্কার করেন একজন আর্জেন্টাইন-পেরুভিয়ান অভিযাত্রী। আশ্চর্যজনকভাবে ল্য দোঞ্চেলার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এখনও অক্ষত রয়ে আছে । দেখে মনে হয় মেয়েটি মাত্র কয়েকসপ্তাহ আগে মারা গেছে। তার মমি দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে কোনো ঔষুধ বা নেশা জাতীয় দ্রব্য খাইয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। গবেষকরা তার চুল পরিক্ষার মাধ্যমে তার মৃত্যুর সময় নির্ধারন করেন।
ইনকা সভ্যতা কি ?
প্রশান্ত মহাসাগরের তীর ধরে প্রায় আড়াই হাজার মাইল জুড়ে আন্দিজ পর্বতমালার বিস্তার।আজকে আমরা যাদেরকে রেড ইন্ডিয়ান বলে জানি, তাদেরই একটি অংশ ইনকা সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের পূর্বেই দক্ষিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যটি ছিল ইনকাদের। বর্তমানে দেশ হিসেবে পেরু, চিলি আর ইকুয়েডরের অংশ বিশেষে ছিল তাদের অবস্থান। ইনকাদের প্রধান সামরিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কেন্দ ছিল কুসকো (cusco) নগরিতে। কুসকো বর্তমানে পেরুর অন্তর্গত। কুসকো অঞ্চলেই প্রথম সাপা ইনকা মাংকো কাপাক ১২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে কাস্কো রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন বলে জানা যায়। এর পরে তার উত্তরসূরিরা আন্দিজ পর্বতমালার অন্যান্য জনগোষ্টিকে নিজেদের আয়ত্বে এনে রাজ্যটির বিস্তৃতি ঘটায়।
১৪৪২ সালের মধ্যেই রাজা পাচকুতিকের (Pachcuti) অধীনে ইনকারা তাদের সাম্রাজ্য দূর-দূরান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত করে। পাচকুতিক (Pachcuti) নামের অর্থ পৃথিবী কাঁপানো মানুষ। ইনকারা সূর্য দেবতা ইতির (Iti) পুজারী ছিলো। তাদের সম্রাটকে “সাপা ইনকা” বা “সূর্য পুত্র” (Son of the Sun) উপাধি দেওয়া হতো। পাচাকুতিক সর্বপ্রথম পূর্ব পুরুষদের পূজা প্রথা চালু করে।
মহামতী সম্রাট টুপা ১৪৯৩ সাল পর্যন্ত ইনকা সাম্রাজ্য শাসন করেন। তার পর সিংহাসনে আসে সম্রাট ওয়াইনা কাপাক। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ওয়াইনা কাপাকের মৃত্যু হয়। অনেকে ধারনা করেন যে ইউরোপিয়ানদের আমদানীকৃত কোন সংক্রামক ব্যাধিতে তার মৃত্যু হয়। সম্রাট কাপাকের মৃত্যুর পর তার দুই ছেলে উয়াসকার ও আতাউয়ালপা ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় । কালক্রমে এ ঘটনা ভয়ানক এক গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়। ১৫৩২ সালে রাজধানী কুজকোর কাছে সংঘটিত হয় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, আতাউয়ালপা পরাজিত করেন তার ভাইকে । তাদের নিজেদের অন্তর্কলহের কারণে তারা ইতিমধ্যেই দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
ইনকা সভ্যতার পতন!
ইনকা সভ্যতার পতনের সাথে যে নামটি উচ্চারিত হয় তা হল স্প্যানীয় যুবক ফ্রান্সিসকো পিজারো। পিজারো যুব বয়সে পশু পালন করত। এর পরে যোগ দেয় সৈন্যবাহিনীতে। ১৫১০ সালে তিনি কলম্বিয়া অভিযানে অংশগ্রহন করেন। কয়েক বছর পরে ঘটনা ক্রমে পিজারো দক্ষিণ আমেরিকার সম্পদপূর্ণ ভূ খন্ডের কথা জানতে পারেন।
নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে পিজারো ১৫২৪ সালের দিকে পানামায় আসে এবং পেরু আক্রমণ করে নসম্পদ লুন্ঠনের এক ছক আঁকতে থাকেন। কিন্তু স্প্যানিশ গভর্নর তার এ পরিকল্পনায় সায় দেননি । ১৫২৮ সালে পিজারো আবারো স্পেনে ফিরে আসেন, স্পেনের শাসক তখন রাজা পঞ্চম চার্লস । পিজারো রাজা পঞ্চম চার্লসের অনুমতি নিয়ে ১৫৩০ সালে পানামায় ফিরে আসে।
১৫৩১ সালে পিজারো পেরুর উদ্দেশ্য যাত্রা করে ১৫৩২ সালের শেষ দিকে কাজামারকার সমৃদ্ধ ইনকা শহরে প্রবেশ করে। মাত্র ১৮০ জন সশস্ত্র সৈন্য নিয়ে পিজারো আগমন করেছিল।
সম্রাট আতাউয়ালপাও তখন কাজামারকায় ছিলেন। ভাই হুয়াস্কারের শাসনাধীন রাজধানী কুজকো আক্রমনের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন । মাত্রই কিছুদিন আগে আতাউয়ালপা ৩০০০ সৈন্যের নেতৃত্বে ইনকা সভ্যতার ইতিহাসে এক বড় যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন তিনি। তাই আতাউয়ালপা হয়ত পিজারোর ১৮০ সহচরকে ভয়ের কিছু নেই ভেবেছিলেন । তিনি কখনো কল্পনাই করেননি এদিকে এই শ্বেতাঙ্গ লোকটি কত ভয়ংকর এক নকশা এঁকে রেখেছে। পিজারো সম্রাটের সম্মানে ভোজের আয়োজন করে। সরল বিশ্বাসে আতাউয়ালপা আর তার কয়েক হাজার সৈন্যসামন্ত নিরস্ত্র অবস্থায় ভোজে অংশগ্রহন করে। কৌশলে পিজারো সম্রাট ও তার যোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে ।
পিজারো সম্রাটের কাছে একজন ধর্ম প্রচারক পাঠিয়ে রাজা চার্লসের আনুগত্য স্বীকার করে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করতে আহ্বান জানায়। এতে আতাউয়ালপা প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে অসম্মানজনক প্রস্তাব বিবেচনা করে বাইবেল মাটিতে ফেলে দেয়। পিজারো এটি সহ্য করতে না পেরে আক্রমনের নির্দেশ দেয় মাত্র অল্প সময়ের মধ্যে ইনকা সৈন্যেদের হত্যা করে স্প্যানীরা আতাউয়ালপাকে বন্দী করে।
বন্দী করার পর আতাউয়ালপার কাছে পিজারো এক ঘর ভর্তি স্বর্ণমুদ্রা মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণ হিসেবে সম্রাট ও তার রাজ্যের অভিজাতরা এক ঘরভর্তি স্বর্ণমুদ্রা দিতে রাজি হয়। এসব বিভিন্ন ঘটনার পরিক্রমায় ইনকা সাম্রাজ্য থেকে স্প্যানিশরা মোট ২৪ টনের মত স্বর্ণরৌপ্য লুট করেছিল ।
আজ পর্যন্ত বিশ্বের ইতিহাসে এই মুক্তিপণই ছিল সবচেয়ে বড় অংকের মুক্তিপণ। এই মুক্তিপন দিয়েও সম্রাটের দুর্ভাগ্য তিনি মুক্তি পান নি। বিশ্বইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে ইউরোপীয়ানরা বরবার বিশ্বাস ঘাতক ছিল। বিশ্বাসঘাতক পিজারো সম্রাটকে মুক্তি দেয়ার পরিবর্তে এক জগন্য ষড়যন্ত্র করে । বৈমাত্রেয় ভাই উয়াসকারকে হত্যা ও আরো কিছু ছোটখাট বিষয়ের দায়ে তাকে স্প্যানিশ বিচারালয়ে পাঠানো হয়। আদালত আতাউয়ালপাকে অপরাধী বলে ঘোষনা করে এবং হত্যার আদেশ দেয়।
১৫৩৩ সালের আগস্ট মাসে সম্রাটকে তার মৃত্যু দন্ডের দুটি উপায় জানানো হয়। সম্রাট যদি খ্রীস্টধর্ম গ্রহন করেন তবে তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হবে এবং তা না হলে তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হবে। ইনকা সভ্যতার নিয়ম অনুযায়ী সম্রাট চেয়েছিলেন তার মৃত্যুর পরে তার দেহ মমিতে সংরক্ষন করা হবে তাই তিনি প্রথম পথ বেঁছে নিলেন । এরপর নিষ্ঠুর আর বিশ্বাসঘাতক পিজারোর আদেশে লোহার শেকল দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় ইনকার সর্বশেষ স্বাধীন সম্রাটকে।
পিজারো অভিযান এখানেই শেষ হয়ে যায় নি। পিজারো তার অভিযান অব্যাহত রাখে এবং ঐ বছরেই স্প্যানীয়দের সহায়তায় কাজামারকার রাজধানী কুজকো আক্রমন করে। ১৫৩৩ সালের নভেম্বরের দিকে কোনঠাসা হয়ে পড়ে ইনকা রাজধানী কুজকো। উয়াসকারের ভাই মানকো কাপাককে সিংহাসনে বসানো হয় এবং তিনি পিজারোর খেলার পুতুলে পরিণত হন। আক্রমন চলে কুইটো সিটিতে। পিজারো পুরোপুরিভাবে ইনকা দখল করে নেয় এবং স্প্যানিশ শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতে থাকে।
পিজারো পানামার সাথে যোগাযোগের সুবিধার জন্য ১৫৩৫ সালে উপকূলের কাছাকাছি লিমা নামে এক নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করে। অন্যদিকে লুটেরা স্প্যানিশদের মধ্যে স্বর্ণ-রৌপ্যের ভাগাভাগি নিয়ে হাঙ্গামা বাধে। মানকো তাদের এই হানাহানির সুযোগ নিয়ে পালিয়ে গিয়ে ১৫৩৬ সালে দুর্গম পাহাড়ি এলাকা ভিলকা বাম্বায় আশ্রয় নেন ও নতুন রাজধানী পত্তন করেন এবং বিদ্রোহ করে। সেখান থেকে মানকো স্প্যানীশদের সাথে গুপ্ত যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কয়েক গুপ্ত যুদ্ধের পরে প্রায় চল্লিশ বছর পরে স্প্যানীয়রা ভিলকা বাম্বার খুঁজ পায় এবং ধ্বংস করে দেয়। এ ঘটনার মধ্য দিয়েই স্প্যানীয় শাসনের কাছে ইনকা সভ্যতার পতন ঘটে। মানকোর এই পরাজয়ের মধ্য দিয়েই সর্বশেষ ইনকা সম্রাট ও তার সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়।
ইনকাদের পথ কাপাকনান
ইনকা ভাষায় ‘কাপাকনান’ অর্থ ‘রাজকীয় পথ’। এই পথের ব্যাপ্তি থেকেইন ইনকা রাজ্যের বিশালত্বের সত্যিকারের ধারণাটি অনুধাবন করা যায় । আন্দিজ পর্বতমালা থেকে শুরু করে আমাজন পর্যন্ত এর ব্যপ্তি। কাপাকনানের রাস্তার জাল ছড়িয়ে আছে দক্ষিণ আমেরিকার ছয়টি দেশজুড়ে—কলম্বিয়া থেকে শুরু হয়ে ইকুয়েডর, পেরু, বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে, আর্জেন্টিনা হয়ে চিলিতে এসে শেষ হয়েছে। সব মিলে কাপাকনান পাড়ি দিয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কিলোমিটার। চওড়ায় কোথাও কোথাও ১৮ মিটার পর্যন্ত। কয়েক শ বছর ধরে গড়ে তোলা হয় রাস্তার এই আশ্চর্য নেটওয়ার্ক। কোথাও সে কাপাকনান গেছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ছয় হাজার ফুট ওপর দিয়ে, কোথাও জলাশয়ের ভেতর দিয়ে, কোথাও ভীষণ গরম জঙ্গল দিয়ে, কোথাও আবার একদম নিষ্প্রাণ মরুভূমির বুক চিরে !
ইনকাদের রাস্তার এই বিস্তৃতি ১৫ শতকে সমৃদ্ধির শিখরে উঠে। তাদের এই সমৃদ্ধ কাপাকনানই তাদের সভ্যতার পতনের কারন বলে ধারনা করা হয়। এমন সমৃদ্ধ রাস্তা না থাকলে স্প্যানীয়রা ঐ দূর্গম অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করার সাহসই হয়ত পেত না।
মাচু পিচু !
পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ইনকাদের গড়ে তোলা শহর মাচু পিচু /মাচ্চু পিচ্চু । মাচুপিচু অর্থ হল পুরানো পর্বত চূড়া, শব্দটি মূলত আমেরিকান প্রাচীন জাতি কেচুয়াদের ব্যবহৃত শব্দ। অধিকাংশ সময় মাচুপিচু নগরী মেঘের আড়ালে ঢাকা থাকে বলে একে মেঘের দেশের নগরীও বলা হত।
১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো মাচুপিচুকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তালিকায় স্থান দেয়৷ সুইজারল্যান্ডভিত্তিক নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশন ২০০৭ সালের ৭ জুলাই মাচুপিচুকে আধুনিক সপ্তাশ্চর্যের একটি বলে ঘোষণা দেয়।
১৪৫০ সালে ইনকারা মাচুপিচু নামে অনিন্দসুন্দর এই নগরটি নির্মাণ করে। এর ঠিক একশ বছর পরই স্প্যানিশদের আক্রমণে ইনকাদের নির্মিত সব শহরই ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু সেদিন স্প্যানিশরা ইনকাদের আর সকল শহরের সন্ধান পেলেও এই শহরটির সন্ধান পায় নি।
পিজারোর সৈন্যরা ভিলকা বাম্বা ধ্বংস করলেও মেঘাচ্ছন্ন পাহাড়ের উপত্যকায় নির্মিত মাচু পিচু তারা খুজেঁ বের করতে পারে নি । হয়ত এ কারনে ইনকাদের অস্তিত্ব জানান দিতে তাই মাচু পিচু অধরা ও অক্ষত থেকে যায়। কিন্তু এর রহস্যের কোন কিনারা হয়নি আজও। কারণ পিজারো ভিলকা বাম্বার মন্দির থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ পাথুরে নগরী ধ্বংস করে ফেলেছিল। ইনকা সভ্যতা বহু দেবদেবীর পূজা করত বলে স্প্যানীয়রা বেছে বেছে স্থানীয় লোকদের সকল ধর্মীয় তীর্থস্থানকে ধ্বংস করে ।
কিন্তু মানুষজন না থাকার কারণে এক সময় মাচু পিচু পরিত্যাক্ত হয়ে যায়। ঠিক কি কারণে মাচু পিচু স্মৃতি থেকে হারিয়ে গিয়েছিল বা পরিত্যক্ত হয়েছিল তার সঠিক তথ্য আজও অজানা রয়ে গেছে। ইনকাদের কোনো লিখন পদ্ধতি বা লিখিত দলিলাদি না পাওয়াই এ রহস্যের অন্যতম কারণ। অনেকে ধারনা করেন গুটি বসন্তের কারনে শহরের লোকজন বিলীন হয়ে যায়। দীর্ঘ চারশ বছর পর ১৯১১ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিরাম বিংহাম নামের এক মার্কিন নাগরিক এই শহরটি আবিষ্কার করেন। আর তা দেখে পৃথিবীবাসী চমকে ওঠে।
হিরাম বিংহামকে মাচু পিচুর আবিষ্কারক বলা হলেও অনেকেই দাবী করে থাকেন আগেই মাচুপিচুতে গিয়েছেন এমন কয়েকজন স্থানীয় তাকে সেখানে নিয়ে যান। যদিও হাইরাম বিংহাম কখনই স্থানীয় সেসব লোকদের কথা কোথাও উল্লেখ করেননি। এমনকি এ শহর আবিষ্কারে তাদের কোন রকম কৃতিত্বও তিনি দেন নি। মেঘের অনেক ওপরে এই শহরের অবস্থান, নিচ থেকে যার অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না! এত আগে এত ওপরে কীভাবে এমন একটা শহর নিরমান সম্ভব হল তা এক বিরাট রহস্য হয়ে আছে এখনো।
স্প্যানীয়রা মাচু পিচু খুঁজে পায় নি অথচ ইনকা রাজধানী কুজকো থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার বা প্রায় ৫০ মাইল উত্তর পশ্চিমে এই নগরীর অবস্থান ছিল। আর কুসকো পেরুর রাজধানী লিমা থেকে ৩৫৭ মাইল পূর্বে অবস্থিত। এটি আন্দিজ পর্বত মালার দু’টি সুউচ্চ শৃঙ্গের মধবর্তী উপতক্যায় অবস্থিত । মাচু পিচুর উচ্চতা সমদ্রপৃষ্ট থেকে ২৩৫০ মিটার বা ৭৭০০+ মিটার।
মাচু পিচুর এক পাশে একেবারে খাড়াভাবে ৬০০ মিটার নিচে প্রবাহমান উরুবাম্বা নদী । পেছনে মাথা উঁচু বিশাল পর্বত শৃঙ্গটি ওয়াইনা পিচু। ধাপে ধাপে বাঁধানো চত্বরগুলো পাহাড়ের গায়ে এমনভাবে স্থাপিত যাতে মূল স্থাপনা ধসে না পড়ে। অনেকের মতে, এসব বাঁধানো চত্বরে ফসল ফলানো হতো । গিরিখাত ও পাহাড়পর্বতের দ্বারা প্রাপ্ত চমৎকার প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কারণে এই শহরের অবস্থান সামরিক কৌশলগত দিক থেকে গোপনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। উরুবাম্বা নদীর ওপর দড়ির তৈরি সেতু ইনকা সৈন্যদের গোপন প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করত । মাচু পিচুর পশ্চিম দিকে গাছের গুড়ি নির্মিত আরেকটি সেতুর অবস্থান ছিল। এই সেতুর মাঝে ৬ মিটার (২০ ফুট) জায়গা ফাঁকা ছিল, প্রয়োজনমত গাছের তক্তা দিয়ে সেতুর দুই অংশকে সংযুক্ত করা যেত। সেতুটির নিচে ৫৭০ মিটার (১৯০০ ফুট) গভীর গিরিখাত, তাই গাছের তক্তা সরিয়ে দিলে কোনও শত্রুর পক্ষে তা অতিক্রম করা দুঃসাধ্য ব্যাপার হত। এই সেতুটি নির্মিত হয়েছিল উরুবাম্বা উপত্যকার ওপর।
মাচু পিচু শহরটি দুই পাহাড়ের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এখান থেকে নিচের উপত্যকা পরিস্কারভাবে দেখা যেত , যা সামরিক দিক সুবিধাজনক অবস্থান। এছাড়া শহরের পেছনের খাড়া পর্বত প্রায় অনতিক্রম্য। মাচু পিচুর পানি সরবরাহ ব্যবস্থা পাহাড়ি ঝরনার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল, যা সহজে বন্ধ করা যেত না। এছাড়াও যে পরিমাণ চাষযোগ্য জমি ছিল তাতে উৎপন্ন ফসলে শহরের মোট জনসংখ্যার চারগুণ মানুষের খাদ্যের সংস্থান সম্ভব ছিল। পর্বতের পাশগুলো ধাপকেটে সমান করা হয়েছিল। এতে একদিকে যেমন চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল, অন্যদিকে খাড়া ঢাল বেয়ে শহরে আসার পথটি আক্রমণকারীদের জন্য দুর্গম করা হয়েছিল। মাচু পিচু থেকে পাহাড়ের ওপর দিয়ে রাজধানী কুজকো যাবার দুটি পথ ছিল, একটি “সূর্য দরজা” দিয়ে, এবং অন্যটি “ইনকা সেতু” দিয়ে। শত্রুর আক্রমণের মুখে দুটি পথই সহজে বন্ধ করে দেয়া যেত। এই শহরের মূল উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল খুবই মজবুত।
মাচু পিচুর বেশিরভাগ স্থাপনাই ঐতিহ্যবাহী ইনকা নির্মান পদ্ধতিতে নির্মান করা হয়েছিল। ইনকা স্থাপনাগুলোর দেওয়াল পাথর নির্মিত অথচ পাথ্র জোড়া দেবার জন্যে কোন রকম সিমেন্ট জাতীয় বা চুন-সুরকির মিশ্রন ব্যবহার করা হয় নি। ইনকারা এসলার (Ashlar) পদ্ধতি ব্যবহার করত। এই পদ্ধতিতে পাথরের টুকরাগুলোকে এমনভাবে নিখুঁতভাবে কাটা হত যে কোন রকম সংযোগকারী মিশ্রণ ছাড়াই পাথগুলো খাজে খাজে শক্তভাবে একটার উপর আর একটা জোড়া লেগে থাকে। নির্মিত পাথরের দেয়ালগুলোর জোড় এতই নিপুন যে একটা পাতলা ছুরির ফলাও সেগুলোর ভেতর দিয়ে প্রবেশ করানো যায় না!
ইনকারা কখনওই ব্যবহারিক কাজে চাকার ব্যবহার করে নি। অথচ তারা কীভাবে এত সংখ্যক বিশাল আকৃতির পাথর খণ্ড এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে গেছে সেটা এক রহস্য রয়ে গেছে ; যদিও সাধারণভাবে ধারনা করা হয় যে, এই বিশাল আকৃতির পাথর খণ্ডগুলো পাহাড়ের সমতল ঢাল দিয়ে ঠেলে ওপরে তুলতে তারা শত শত শ্রমিক ব্যবহার করেছিল। এখনও কিছু কিছু পাথরের গায়ে হাতলের মতো গাঁট রয়েছে যা পাথরগুলোকে নির্দিষ্ট স্থানে বসানোর জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। পাথর খণ্ডগুলো জায়গামতো স্থাপনের পর ইনকারা হয়ত হাতলগুলোকে গুড়িয়ে সমান করে দিয়েছে।
পেরু বেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা বলে সিমেন্টের জোড়া হলে এই ভূমিকম্পে স্থাপনাগুলো টিকত কিনা সন্দেহ আছে । কিন্তু পাথরের খাঁজে খাঁজে বসিয়ে তৈরি করা বলে মাচুপিচুর এই স্থাপনাগুলো বেশ ভূমিকম্পপ্রতিরোধী। হয়ত এ কারনেই ইনকাদের এই শহর গত ৫০০ বছরে অসংখ্য ভূমিকম্প সহ্য করেও নিজের অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে !
মাচু পিচু শহরটিতে ১৪০ টির মত স্থাপনা রয়েছে যার মধ্যে রয়েছে কিছু মন্দির, পবিত্র স্থান, উদ্যান এবং আবাসিক ভবনসমূহ । মাচু পিচুতে রয়েছে ১০০টিরও বেশি সিড়ি। এখানে আরও রয়েছে প্রচুর সংখ্যক ঝর্না, যেগুলো পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছিল এবং ছোট ছোট খালের মাধ্যমে পরস্পর সংযুক্ত এবং এসব ঝর্না মূলতন সেচ কাজে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল ।
সার কথা
সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে অনেক সভ্যতা কিন্তু তাদের অস্তিত্ব আজো টিকে আছে ইতিহাসের পাতায়। কোন কোন সভ্যতার নির্দশন হারিয়ে গেছে আর কোন সভ্যতার নিদর্শন আজো পৃথিবীর বুকে টিকে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে অনেক সভ্যতার উত্থান পতন হয়েছে। ব্যবিলনের শূন্য উদ্যানের মত কারো কারো গড়ে তুলা স্থাপত্য আজও টিকে রয়েছে । তাদের গড়ে তোলা সে স্থাপত্য আজও আমাদের বিষ্মিত করে। সে রকম একটি হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা হল ইনকা সভ্যতা ।
তথ্য সূত্রঃ
উকিপিডিয়া, দেশি বিদেশী নানা ব্লগ সাইট।