ইকো ব্রীজ বন্য প্রাণীর নিরাপদ চলাচলে রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা !

সভ্যতার উৎকর্ষতার সাথে সাথে প্রতিনিয়তই আমাদের নতুন নতুন শব্দ কিংবা ব্যবস্থার সাথে পরিচিত হতে হচ্ছে। কোনটি সভ্যতার জন্যে হুমকিস্বরূপ আবার কোনটি আবার কল্যানকর।

এমনই একটি নতুন ব্যবস্থার সাথে আমরা আজকে পরিচিত হতে যাচ্ছি ।  ইকো ব্রীজ শব্দটা অনেকের কাছেই হয়তবা পরিচিত আবার অনেকের কাছে একদম নতুন একটা শব্দ ! এই শব্দটি কি বা কি উদ্দেশ্যে ব্যবহার হয় সেটিই আজকে আমরা জানার চেষ্টা করব। 

ইকো ব্রীজ কি এবং কেন? 

মানুষের চলাচলের সুবিধার জন্যে জলাশয়ের উপরে, দুই পাহাড়ের মাঝে কিংবা শহরাঞ্চলে জ্যাম থেকে মুক্তি পেতে রেগুলার চলাচল পথের উপর দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন নামে ব্রীজ স্থাপন করা হয়। ইকো ব্রিজও কিন্ত তেমন একধরনের ব্রীজ 

একসময় বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ছিল বনভূমি। সেসব বনে ছিল হাজার হাজার প্রজাতির পশু-পাখি।  সময় পরিক্রমায় মানুষের বসবাসের জন্যে অবকাঠামো, চলাচলের জন্য রাস্তাঘাট, উন্নয়নের নামে অন্যান্য অবকাঠামো কিংবা কৃষিকাজের জন্যে প্রচুর বনভুমি উজাড় শুরু হয়। ফলে বনভূমিগুলো খন্ডিত হতে থাকে।

মানব অকাঠামো নির্মাণের ফলে প্রাণীর নিয়মিত চলাচল বাধাগ্রস্থ হতে থাকে কোথাও কোথাও দেখা যায় রাস্তা পার হতে গিয়ে শেয়াল, সাপ, সজারু কিংবা অন্য কোন প্রাণী রাস্তায় গাড়ির নীচে পড়ে মারা পড়ছে । একই সাথে বনের মধ্য দিয়ে চলাচলের রাস্তায়  হুট  কোন প্রাণী চলে আসায় গাড়ি এক্সিডেন্ট হচ্চে ফলে মানুষও হতাহত হচ্ছে। এই সমস্যা থেকে উত্তরনের জন্যেই আসে ইকো ব্রীজ ব্যবস্থা। 

ইকো ব্রীজ

আধুনিক শহরগুলোতে কিংবা হাইওয়েতে প্রচুর পরিমাণে যানবাহন চলাচল করে। ফলে রাস্তা পারাপার মানুষের জন্যে নিরাপদ নয়। নিরাপদে রাস্তা পারাপারে মানুষ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে জেব্রা ক্রসিং। পথচারী পারাপারের জন্য ব্যস্ত রাস্তায় সাদা-কালো ডোরাচিহ্নিত নির্দিষ্ট অংশ জেব্রা ক্রসিং নামে পরিচিত। আবার পারাপারের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে পদচারী-সেতু বা ওভার ব্রীজও ব্যবহার করা হয়।

মানুষের নিরাপদ পারাপারের জন্যে জেব্রাক্রসিং কিংবা ফুটওভারব্রিজ থাকলেও একই সাথে প্রাণীর চলাচলের জন্যে নেই কোন ব্যবস্থা। এই ধারনা থেকেই আসে  ওয়াইল্ড লাইফ করিডোর (Wildlife corridors) বা ইকো ব্রীজ বা  ইকোলজিক্যাল ব্রীজ। 

মূলত বলতে গেলে ইকোব্রীজ হল পাশাপাশি দুই বা ততোধিক বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলের মধ্যাকার লিংক বা সংযোগ পথ যা সাধারণত স্থানীয় গাছপালা ব্যবহার করে তৈরি করা হয়।  

বন্যপ্রাণী করিডোরগুলি প্রাণী এবং উদ্ভিদ জনসংখ্যার মধ্যে সংযোগ বজায় রাখতে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে অন্যথায় প্রানীগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে ফলে প্রাণীগুলো বিলপ্তির পথে চলে যেতে পারে। 

একই সাথে  বন্যপ্রাণীরা এক্সপ্রেসওয়ে অতিক্রম করে এক রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে অন্য ফরেস্টে যাওয়ার ফলে, বিরল উদ্ভিদের পরাগায়ন এবং বিচ্ছুরণের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যেতে পারে।

ইকো সেতু নির্মাণ 

এই প্রাণী সেতু মানুষ-প্রাণী’র সরাসরি সংস্পর্ষ এড়াতে সাহায্য করবে। ইকো সেতু নির্মাণে দুটি প্রধান দিক বিবেচনা করা হয় আকার এবং অবস্থান। এই সেতুগুলি পশু চলাচলের ধরণগুলির উপর ভিত্তি করে তৈরি করা উচিত। 

ইকো-সেতুগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে: আন্ডারপাস টানেল, ভায়াডাক্টস এবং ওভারপাস (প্রধানত বড় বা পশু-পাখির জন্য), উভচর টানেল, ক্যানোপি ব্রিজ (বিশেষ করে বানর এবং কাঠবিড়ালির জন্য), টানেল এবং কালভার্ট (ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী যেমন ওটার, হেজহগ এবং ব্যাজারদের জন্য),  সবুজ ছাদ (প্রজাপতি এবং পাখিদের জন্য)। 

পশ্চিম সিঙ্গাপুরের বুকিত তিমাহ এক্সপ্রেসওয়েতে ২০১২ সালে Eco-Link@BKE নামে একটি ইকো ব্রীজ নির্মাণ করা হয়। পরে এটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। এটি দেখতে অনেকটা Hourglass বা বালু ঘড়ির আকৃতির। 

এই ইকো-লিঙ্ক নির্মানের পরিকল্পনা শুরু হয় ১৯৯৪ সালে এবং অবশেষে ২০০৯ সালে নির্মাণের ঘোষণা আসে। ২০১১ সালে নির্মাণ শুরু হয় এবং ২০১২ সালে সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ করে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।  এশিয়া প্যাসিফিকের প্রথম ইকো ব্রীজের সবচেয়ে সরু অংশের প্রস্থ হল ৫০ মিটার বা ১৬০ ফিটের মত। 

সেতুটি স্থানীয় গুল্ম ও গাছাপালা দিয়ে আচ্ছাদিত এর ফলে প্রাণীদের কাছে এটি স্বাভাবিক বনভুমির অংশই মনে হয়। সেতুর কিনারে পশু পারাপারের ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা  বসানো হয়েছে ।

ইকো ব্রিজ নির্মানের পূর্বে রাস্তার পাশে প্রচুর মৃত পেঙ্গুলিন  পড়ে থাকতে দেখা যেত। ২০১৪ সালের পরে রাস্তায়  আর কোন পেংগুলিন পড়ে থাকতে দেখা যায় নি। একই সাথে এক পাশের বন্য প্রানীকে অন্যে পাশে বিচরন করতে দেখা যায়। 

সিঙ্গাপুরের পরে ভারতও শুরু করে ইকো ব্রীজ নির্মানের প্রজেক্ট। ভারতের রাস্তায় প্রায়ই দেখা যায় বন্য প্রাণীর সাথে গাড়ির সংঘর্ষ হয়। উত্তরখন্ডে কালাধুঙ্গি-নৈনিতাল হাইওয়েতে ( Kaladhungi-Nainital highway) ছোট প্রাণী চলাচলের জন্যে প্রথম ২৭ মিটার দৈর্ঘ্যের ইকো ব্রীজটি  ঘাস, বাশ দড়ি ব্যবহার নির্মান করা হয়। 

বনের ভেতরে চলে গেছে পিচঢালা রাস্তা। তার উপরে দেখা যাচ্ছে একটি সেতু। দেখতে পর্যটকদের জন্য মনে হলেও প্রাণীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে এটি।

এর পরে ভারত দিল্লী- মোম্বাই হাইওয়েতে ৫টি আন্ডার পাসের মাধ্যমে প্রায় ২.৫ কিলোমিটারের প্রসারিত ইকোব্রীজ নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেয়। ২০২২ সাল নাগাদ এগুলো উদ্ভোধন হতে পারে ।

এ ছাড়া দক্ষিন কুরিয়াতেও একটি দৃষ্টি নন্দন ইকো ব্রীজের প্রস্তাব করা হয়েছে। 

Yangjaegogae Eco Bridge In Korea

বাংলাদেশেও একাধিক বনের মধ্য দিয়ে রাস্তা চলে গিয়েছে। লাওয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্টে বড় করে সাইনবোর্ড টানানো বন্য প্রাণী চলাচলের রাস্তা গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে রাখুন। এছাড়াও খাদিমপুর, গাজীপুর, কক্সবাজারে বন চিড়ে দুইভাগ করে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। মানুষের চলাফেরাতে প্রাণীর চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে । এসব রাস্তায় একাধিক ইকো ব্রীজ নির্মাণ করা হলে প্রাণী বৈচিত্র্য স্বাভাবিক থাকবে। 

মনজু
 

Click Here to Leave a Comment Below 0 comments

Leave a Reply: