ব্ল্যাক বক্স নিয়ে কিছু কথা
ব্ল্যাক বক্স কি ?
সৃষ্টির সূচনা লগ্ন হতে মানব সভ্যতার একটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার বলা চলে উড়োজাহাজ তথা বিমান । বিমান আবিষ্কারের পর থেকে মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে খুব দ্রুত গমন করার জন্যে একে ব্যবহার শুরু করে । বলা যায় পৃথিবীর ব্যাসার্ধ প্রায় কমে গেছে অনেকখানি । এর ফলে বেঁচে যাচ্ছে আমাদের অনেক মূল্যবান কর্ম ঘণ্টা। তবে হঠাৎ হঠাৎ দেখা যায় হাজার ফুট উপর দিয়ে চলা এসব বিমানের চালকরা হয়ে পড়েন অসহায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ঘটে যায় বিরাট কোন দুর্ঘটনা। যার ফলাফল হয়ত হাজার মানুষের প্রাণহানি। দেখা গেছে পরিসংখ্যান মতে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ১২০০ জন মানুষ বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়। আর এই দূর্ঘটনা ঘটার পরে জোরে সোড়ে ব্ল্যাক বক্স শব্দটা উচ্চারিত হয়।
গত ৮ মার্চে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান এম এইচ ৩৭০, ২৩৯ জন যাত্রী নিয়ে কুয়ালালামপুর থেকে বেইজিং যাওয়ার পথে মাঝ আকাশ থেকে উধাও হয়ে যায়। সেই বিমানের খোঁজ এখনো মেলেনি। হন্যে হয়ে চষে বেড়ানো হয় সম্ভাব্য এলাকাতে। খুজে পাওয়া যায়নি বিমানটি। এই রকম শত শত উদাহরন আছে বিমান নিখোঁজ হবার বা দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে ধ্বংস হবার।৩১ শে জানুয়ারী, ২০০০ সালে মেক্সিকো এর পুয়ের্তো ভালার্তা(Puerto Vallarta) বিমান বন্দর থেকে একটা উড়োজাহাজ রওনা হলো ওয়াশিংটন এর সিয়াটল উদ্দেশ্যে | সান ফ্রান্সিসকোতে মাঝখানে ছোট্ট একটা বিরতি নেবার কথা ছিল | যাত্রা শুরুর মোটামুটি ১ ঘন্টা ৪৫ মিনিটের মধ্যেই সেই যাত্রার সলিল সমাধি ঘটে ; বিমানের stabilizer সমস্যা দেখা দেয় পাইলট আপ্রাণ চেষ্টা করেন বিমানটিকে রক্ষা করার | কিন্তু মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যেই তাদের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে বিমানটি আছড়ে পড়ে যায় ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূল থেকে দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে | বিমানের ৮৮ জন যাত্রীর কেউই প্রাণে বাঁচেননি |
এ ধরনের দূর্ঘটনার পরে প্রথমেই আসে ব্ল্যাক বক্সের নাম । কারন সাধারন প্ল্যান ক্রাসের পরে আরোহীরা বেচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। প্রায় সকলেই হয়ত ব্ল্যাক বক্সের নাম শুনে থাকবেন। অনেকেই হয়ত অনেক বেশি কিছু জানেন আবার অনেকের হয়ত এই ব্যাপারে জ্ঞান শূন্য। আমার নিজের সীমাবদ্ধ মুখস্থ বিদ্যা আর ওয়েবের সাহায্যে ব্ল্যাক বক্স নিয়ে আলোকপাত করব। যদি ভুল বলে থাকি বা কোথাও ঘাটতি থাকে তাহলে আশা করি উল্লেখ করবেন।
বিমান দুর্ঘটনার সঠিক কারণ জানার জন্য ব্ল্যাক বক্স নামে একটি যন্ত্র বিমানে বহুল ব্যবহৃত হয়। এখন মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে ব্ল্যাক বক্স আসলে কি? ব্ল্যাক বক্স হল এক ধরণের যন্ত্র বা ডিভাইস যা কিনা বিমানের বিভিন্ন তথ্য ধারণ করে রাখে। বিমান দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করতে করতে ব্ল্যাক বক্স ব্যবহৃত হয় । এই ব্ল্যাক বক্সে একটি রেকর্ডার সিস্টেম চালু থাকে। যার ফলে উড্ডয়নের সময়ের বিভিন্ন তথ্য রেকর্ড হয়ে থাকে অনেক বৈমানিকরা বিমানে ব্ল্যাক বক্স রাখতে চান না।
ব্ল্যাকবক্স বিমানের ভীতরের অডিও এবং ভিডিও ধারণ করা ও নিখুঁত অবতরণ সম্পর্কিত নানা তথ্য জানায় বলেই হয়ত এই অপছন্দ। বিমান দুর্ঘটনা ও ছিনতাইয়ের তদন্ত কাজে তথ্য প্রদানে ব্ল্যাকবক্স উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে । দুর্ঘটনায় বিমান সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হলে কিংবা সমুদ্রের অতল গভীরে তলিয়ে গেলেও ব্ল্যাকবক্স কার্যকর থাকে এবং অডিও-ভিডিওর তথ্য সংরক্ষিত থাকে।সাধারণত একটি ব্ল্যাক বক্সের দুটি অংশ থাকে। একটি হচ্ছে Flight data recorder বা FDR। FDR বিমানের পেছনে রাখা থাকে। ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার বিমানের যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ, গতি, দিক এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য তথ্য ধারণ করে। এটা পাঁচ থেকে কয়েক হাজার রকমের তথ্য উত্তরণকালের ২৫ ঘণ্টা সময় রেকর্ড করে রাখে।। অপরটি হল Cockpit voice recorder বা CVR। এটা রাখা হয় বিমানের পাইলটদের ঘরে। এটি ককপিটের মধ্যে যে কোন ধরণের শব্দ রেকর্ড করে রাখে। ককপিট ভয়েস রেকর্ডার দুর্ঘটনার শেষ ৩০ মিনিটের কথাবার্তা এবং ককপিটের অন্যান্য শব্দ ধারণ করে।
ব্ল্যাক বক্স প্রথম ডঃ ডেভিড ওয়ারেন নামে একজন অস্ট্রেলিয়ান বিজ্ঞানী দ্বারা আবিষ্কৃত হয়. ওয়ারেন মেলবোর্নে বৈমানিক গবেষণা ল্যাবরেটরিতে ১৯৫০ দশকের মাঝামাঝি কাজ করার সময় পৃথিবীর প্রথম কমার্শিয়াল জেট কমেট এর রহস্যজনক ক্রাসের তদন্তে জড়িত থাকাকালীন উপলব্ধি করেন ক্র্যাসের পূর্বে একটা ডেটা রেকর্ডার যদি থাকত । ১৯৫৭ সালের দিকে এটি বানানো হয়। কিন্ত ১৯৬০ সালের অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে একটি বানিজ্যিক এয়ার লাইনার ক্রাশ করলে প্রথমে ব্ল্যাক বক্স বিমানে স্থাপনের বাধ্যবাধকতা প্রদান করা হয়। বর্তমানে যুদ্ধ বিমান, যাত্রীবাহী বিমান, মাল পরিবহন-বিমানসহ সব হেলিকপ্টারে ব্ল্যাকবক্স রাখা আবশ্যক।
ব্ল্যাক বক্স শব্দগত অর্থে কালো বাক্স বুঝালেও এর রঙ কালো না । এটা দেখতে কমলা রঙ এর। দুর্ঘটনার ফলে সৃষ্ট ধ্বংস স্তূপের মধ্যে থেকে যেন খুব সহজেই ব্ল্যাক বক্স খুঁজে বের করা যায় তাই এটির রঙ কমলা রঙ করা হয়েছে। আসলে ব্ল্যাকবক্স নামের কারনটা অজানা তবে ধারনা করা হয় আগে এই রেকর্ডারগুলোর রং হত কালো বলেই একে ব্ল্যাক বক্স নামে ডাকা হত | আবার অনেকে মনে করেন , দুর্ঘটনার পর আগুনে পুড়ে এর রং কালো হয়ে যায় বলেই এ নামে একে ডাকা হয় | অনেকে আবার বলেন, দুর্ঘটনা, মৃত্যু এসব খারাপ ব্যাপারকে মাথায় রেখেই এরকম নাম করন করা হয়েছে।
ব্ল্যাকবক্স অভিকর্ষের চাপ থেকে ৩৪০০ গুণ বেশি চাপ সহ্য করতে পারে । ব্ল্যাক বক্স এমন ভাবে তৈরি করা হয় যেন তা উচ্চ তাপমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। দুর্ঘটনায় পতিত বিমানটি পুড়ে গেলেও ব্ল্যাক বক্স থাকে অক্ষত।৩০ মিনিট ১১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে এবং ২০ হাজার ফুট পানির নিচে গেলেও নষ্ট হয় না ব্ল্যাক বক্সের কার্যকারিতা।
দূর্ঘটনার পরে ব্ল্যাক বক্স খুঁজে পাওয়া নিশ্চিত করার জন্য কমলা রঙ্গে রঞ্জিত করার পাশাপাশি আরো কিছু কারিগরী ফলানো হয় | যানবাহনের গায়ে বা হাইওয়ের পাশে রোডসাইন গুলোতে যেমন refelctive material সংযুক্ত করা থাকে, তেমনি রিফ্লেক্টিভ টেপ লাগানো থাকে ব্ল্যাক বক্স এর গায়েও | আর সবচেযে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটি লাগানো সেটি হল হলো underwater locator beacon | পানির সংস্পর্শে এলেই ব্ল্যাক বক্সে লাগানো সেন্সরটা underwater locator beacon টাকে চালু করে দেয় |যখনই এটা চালু হয় তারপর থেকে underwater locator beacon টা প্রতি সেকেন্ডে একবার করে ultrasonic শব্দের ঢেউ ছাড়তে থাকে পরের ৩০ দিন পর্যন্ত | এটি হতে নির্গত শব্দ মানুষের কানে ধরা পরে না ঠিকই, কিন্তু sonar বা acoustical locating ডিভাইজে ঠিকই ধরা পরে।
ব্ল্যাক বক্সে তথ্য ধারণ করার জন্য ব্যবহার করা হয় এক প্রকার ম্যাগনেটিক টেপ । এই ম্যাগনেটিক টেপ দেখতে অনেকটা পুরনো দিনের ক্যাসেটের ফিতার মত যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০০০ ফুট। ব্ল্যাক বক্সের আবরণ উচ্চ তাপ সহনশীল স্টিল দিয়ে তৈরি যেন দুর্ঘটনার ফলে উৎপন্ন হাজার ডিগ্রী তাপমাত্রা এটির কোন ক্ষতি না হয় । এর ফলে তথ্য সুরক্ষিত থাকে বহাল তবিয়তে ।এক একটি ব্ল্যাক বক্স বানাতে প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার ডলার এর মত খরচ হয় ।
ব্ল্যাক বক্স থেকে তথ্য উদ্ধারের প্রক্রিয়াটি অনেক জটিল। অনেক সময় দিনের পর পর দিন লেগে যায় তথ্য উদ্ধার করতে।
লিখতে গিয়ে টেকনিক্যাল টার্মগুলো যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি। কারন এগুলো আমারও মাথার উপর দিয়ে যাবে। প্রত্যাশা করি যেন কোন দিন ব্ল্যাক বক্সের ডাটা এনালাইসিস না করতে হয়।