প্রায় দুই শতাব্দি ধরে চলে আসা ৩৩ নম্বরের পাশের প্রচলন !
লাবিব অংকে খুব কাঁচা। সবই ঠিক আছে কিন্ত অংকের কথা শুনলে হাত-পা কাপা-কাপি হয়ে তার অজ্ঞান হবার যোগাড়। অংক করার চেয়ে সারা দিন রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে বললে তাতে তার আপত্তি নাই ! এলাকার উঠতি বয়সি ছেলে পেলে লাবিবের ভয়ে টটস্থ থাকে। আর তার কিনা অংক ক্লাসে নিয়মিত কানমলা খেতে হয়!
একটা এলাকার ত্রাস কিনা অংকের ভয়ে স্কুল ছেড়ে দিবার পায়তারা করে ! অংকে পাশ নম্বর ৩৩ তুলতে পারলে লাবিব এলাকায় ছেলে-পেলেদের একদিন চা খাওয়ায়। হুম এই পাশ মার্ক ৩৩ নিয়ে এত কথা। আমরা কি জানি কবে এই পাশ মার্ক ৩৩ এর প্রচলন শুরু হয়েছিল বা কিভাবেই বা এই পাশ মার্ক ৩৩ নির্ধারণ করা হয়েছিল?
বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে ৪৭ বছর হল। বাংলাদেশে জন্মের পর থেকে এখনো পর্যন্ত ৩৩ নম্বর পাশ নম্বর হিসেবে প্রচলিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ পাকিস্থানের নিয়ন্ত্রণে ছিল ২৩ বছর। তখনো ৩৩ই পাশ মার্ক হিসেবে বিবেচিত ছিল। পাকিস্থানের পূর্বে ছিলাম তদানন্তিন ব্রিটিশ বেনিয়াদি শাসকদের নিয়ন্ত্রণে। তখনো কি পাস মার্ক ৩৩ ই ছিল ? চলুন একটু গভীরে যাওয়া যাক।
১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার হাত থেকে ব্রিটিশ কোম্পানি ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়। এর পরে চলে যায় এক শতাব্দি। কোম্পানির বিরুদ্ধে ছোট খাট বিদ্রোহ দেখা গেলেও বড় আকারে বিদ্রোহ হয় ১৮৫৭ সালে। এটি সিপাহি বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
সিপাহি বিদ্রোহ ১৮৫৭ সালের ১০ মে মিরাট শহরে শুরু হওয়া ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীর সিপাহিদের একটি বিদ্রোহ। ক্রমশ এই বিদ্রোহ গোটা উত্তর ও মধ্য ভারতে অধুনা উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও উত্তর মধ্যপ্রদেশ এবং দিল্লি অঞ্চল ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সব অঞ্চলে বিদ্রোহীদের দমন করতে কোম্পানিকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।
সিপাহি বিদ্রোহের পর ১৮৫৮ সালে ভারতে কোম্পানি-শাসনের অবসান ঘটে এবং ব্রিটিশ সরকার তথা রানীর হাতে উপমহাদেশের ক্ষমতার ভার চলে যায়।
এর পরে ব্রিটিশরা সেনাবাহিনী, অর্থব্যবস্থা ও ভারতীয় প্রশাসন পুনর্গঠনে বাধ্য হয়। একই সাথে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনে। ১৮৫৮ সালে প্রথম বারের মত উপমহাদেশে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ মেট্রিকুলেশন পরিক্ষা চালু করে। কিন্ত সমস্যা দেখা দেয় পাশ মার্ক হিসেবে কত ধরা হবে। বোর্ড কর্তৃপক্ষ বিট্রেনে এই নিয়ে পত্র লিখে !
এই নিয়ে যখন দ্বিধা-দ্বন্দ চলছিল সে সময় ব্রিটেনে পাশ নম্বর ছিল ৬৫। সে সময় ইংরেজ সমাজে একটা প্রচলিত ধারণা ছিল ‘The people of subcontinent are half as intellectual and efficient as compared to the British’ অর্থাৎ বুদ্ধি ও দক্ষতায় উপমহাদেশের মানুষকে ইংরেজদের তুলনায় অর্ধেক মনে করা হত।
একই ধারাবাহিকতায় মেট্রিকুলেশনের পাস নম্বর ৬৫ এর অর্ধেক ৩২.৫ নির্ধারণ করা হয়। ১৮৫৮ সাল থেকে ১৮৬১ সাল পর্যন্ত পাস নম্বর ৩২.৫ ই ছিল। পরবর্তীতে ১৮৬২ সালে তা গণনার সুবিধার্থে বৃদ্ধি করে ৩৩ করা হয়। সেই থেকে এখনো বিরামহীন ভাবে ৩৩ নম্বরই পাশ নম্বরের সীমা হিসেবে চলছে।
প্রায় দুইশত বছর গত হতে চলছে অথচ এখনো আমরা ব্রিটিশদের ধরিয়ে দেওয়া সেই অর্ধেক বুদ্ধি আর দক্ষতার পাশ নম্বর নিয়েই চলছি। কত ক্ষেত্রে সংস্কার নিয়ে আসছি অথচ শিক্ষার মত মৌলিক অধিকারে এখনো আমরা পড়ে আছি শতাব্দি পিছিয়ে। মান সম্মত শিক্ষার জন্যে পরিবর্তন আসা দরকার বলে মনে করছি।